
আজ ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। ১৯৯৪ সাল থেকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় দিবসটি। প্রতিবছর ৯ আগস্ট সারা বিশ্বব্যাপী এই দিনটিকে আদিবাসীদের স্মরণে উদযাপন করেন বিভিন্ন দেশের কয়েক কোটি মানুষ। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আদিবাসী তরুণরাই মূল শক্তি’।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বে শ-খানেক দেশে প্রায় ৫০ কোটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। তাদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি, ইনডিজেনিয়াস পিপল, ট্রাইবাল অথবা নেটিভ পিপল ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১.১ শতাংশ আদিবাসী।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে আদিবাসী শব্দ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা উপজাতি হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে এসব গোষ্ঠীগুলোর অনেকেই নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করে।
দিবস ঘিরে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এবার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ ১২ দফা দাবি সামনে এনেছে। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিজেদের ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতি বজায় রাখতে দেশের সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসীরা সোচ্চার। বর্তমান সময়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লড়াই-সংগ্রামের মূল শক্তি তরুণরা।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বাণীতে বলেছেন, ‘আমরা আদিবাসী তরুণদের পরিবর্তন আনয়ন ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের অবদানকে স্বীকৃতি দিই এবং উদযাপন করি। বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনগণ কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে; তাদের ভূমি ও সম্পদের অধিকার হুমকির মুখে। তাদের অধিকার অবদমিত এবং তারা ক্রমাগত বিপন্নতা, প্রান্তিকতা ও বঞ্চনার শিকার। তবে আদিবাসী তরুণরা অধিকার ফিরে পেতে সংগ্রাম করছে।’
সোচ্চার আদিবাসী তরুণ নিজেদের অধিকার আদায়ে আদিবাসী তরুণরা সোচ্চার। তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে, মাঠে নামছে। এই তরুণ সমাজই এ সম্প্রদায়ের পথপ্রদর্শক। এবারের আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘের মূল দৃষ্টি তরুণ সমাজের দিকে। তরুণরা একদিকে সংগ্রামে আছে, বিপরীতে রয়েছে বেকারত্বের হতাশা। তাদের চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বাতিল করা হয়েছে। গত দুটি বিসিএসে বেকার আদিবাসী তরুণদের অবস্থান শূন্যের ঘরে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করে বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠী শব্দ ব্যবহার করতে। আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করতে উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। এর কারণ, এখানকার মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি চার হাজার বছরের পুরনো। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা সেটিই প্রমাণ করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবারত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া থেকে এসে বসতি স্থাপন করে। সে জন্য তারা এখানকার আদিবাসী নয়। তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো আজ বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন করছে এবং তারা নিজেদেরকে আদিবাসী বলেই পরিচয় দিয়ে থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে ৫০টি জাতি-গোষ্ঠীর আদিবাসীর সংখ্যা ৪০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ তরুণ। এর বড় একটি অংশই বেকার। কম শিক্ষিত বেকার তরুণরা কৃষিকাজ কিংবা জুম চাষ করে। এ ছাড়া জীবিকার তাগিদে তারা নানা কাজের সঙ্গে জড়িত। আদিবাসী তরুণরা আগের চেয়ে শিক্ষিত হয়েছে বলে তারা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হচ্ছে। তারা রাজনৈতিকভাবেও সচেতন হচ্ছে।
সূত্র জানায়, জাতিসংঘ ২০০০ সাল থেকে আদিবাসীদের জন্য স্থায়ী ফোরাম ‘ইউএনপিএফআইআই’ গঠন করেছে। এতে রয়েছে ছয়টি থিম। এগুলো হলো শিক্ষা, মানবাধিকার, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ অন্যান্য অধিকার।
১২ দফা দাবি
আদিবাসী ফোরামের ১২ দাবি হলো– আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া; আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা; আদিবাসী তরুণ সমাজের নেতৃত্ব বিকাশ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া; আদিবাসী ইস্যুতে অন্য দেশের মতো সরকার, জাতিসংঘ ও আদিবাসী জনগণ– ত্রিপক্ষীয় সংলাপের জন্য উৎসাহ ও প্রণোদনা দেওয়া; পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা।
এ লক্ষ্যে সময়সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা করা, সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করা; আদিবাসীদের ভূমিতে তাদের সম্মতি ছাড়া ইকোপার্ক, সামাজিক বনায়ন, ট্যুরিজম, ইপিজেড বা অন্য কোনো প্রকল্প না নেওয়া; আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধ করাসহ সব মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা; জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসীবিষয়ক ঘোষণাপত্র ও আইএলও ১৬৯ নম্বর কনভেনশন অনুসমর্থন ও আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন করা; জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ বা আসন বরাদ্দ রাখা; সরকারি প্রথম শ্রেণিতে আগের মতো আদিবাসী কোটা সংরক্ষণ এবং অন্য চাকরিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোটা যথাযথ বাস্তবায়ন করা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং সমকালকে বলেন, বিদ্যমান আইনে আদিবাসীদের ভূমি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
আদিবাসীদের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারকে নিতে হবে বিশেষ উদ্যোগ। বেকার আদিবাসী তরুণদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে আদিবাসী কোটার পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে।