নওগাঁয় মৌসুমে ধানের দাম কমলেও কমেনি চালের দাম

ধানে সমৃদ্ধ উত্তরের জেলা নওগাঁয় এবছর বোরো মৌসুমে প্রায় ১৩ লক্ষ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। কাটা মাড়াই শেষ হয়ে পেরিয়েছে ২ মাস।

বাম্পার ফলনে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে কমেছে সব ধরনের ধানের দাম। তবে এর কোনো প্রভাব পড়েনি চালের বাজারে। ভরা মৌসুমেও টানা এক মাস যাবত জেলার পাইকারী ও খুচরা বাজারে স্থিতিশীল রয়েছে চালের দাম। শীঘ্রই এই দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যা ভোক্তা পর্যায়ে চরম অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে চালের বাজারে স্বস্তি ফেরানোর দাবি জানিয়েছেন সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষরা।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এবছর নওগাঁয় বোরো, আউশ ও আমন মৌসুমে ১৬ লক্ষ টনের অধিক চাল উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় চাহিদা রয়েছে মাত্র ৬ লক্ষ টন। বাকী ১০ লক্ষ টনের অধিক চাল ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করা হচ্ছে। এরমধ্যে এবারের বোরো মৌসুমেই ৮ লক্ষ ৪৯ হাজার ৪১০ টন চাল উৎপাদনে প্রয়োজনীয় ১২ লক্ষ ৭৪ হাজার ১১৫ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে।

জেলার বিভিন্ন হাট বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে মানভেদে প্রতি মণ ব্রি ধান-২৮ এগারোশো পঞ্চাশ টাকা, সুভলতা এগারোশো টাকা, মিনিকেট বারোশো পঞ্চাশ টাকা থেকে বারোশো আশি টাকা, কাটারী এগারোশো সত্তুর টাকা থেকে এগারোশো আশি টাকা দরে কেনাবেচা করছেন ব্যবসায়ীরা। অথচ গত ১ মাসের ব্যবধানে প্রতি মণ ধানের দাম ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

সরেজমিন শহরের পার নওগাঁ মহল্লার আড়তদারপট্টি ও পৌর চাল বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে পাইকারী পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৪৬-৪৭ টাকা, ব্রিধান-২৮ ৪৮-৪৯ টাকা, সুভলতা ৪৫-৪৬ টাকা, মিনিকেট ৫৬-৫৭ টাকা এবং কাটারীভোগ ৫৮-৬০ টাকা দরে বিক্রি করছেন মিল মালিক ও আড়তদাররা। অপরদিকে, খুচরা পর্যায়ে মানভেদে প্রতি কেজি স্বর্ণা-৫ জাতের চাল ৪৮-৫০ টাকা, সুভলতা ৫২-৫৪ টাকা, মিনিকেট ৬০-৬২ টাকা এবং কাটারীভোগ ৬০-৬৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। গত এক মাস যাবত জেলায় পাইকারী ও খুচরা পর্যায়ের এই বাজার দর স্থিতিশীল রয়েছে।

শহরের আরজী নওগাঁ মহল্লা থেকে খুচরা চাল বাজারে আসা ভ্যানচালক রাজ্জাক হোসেন বলেন, ভ্যানে মালামাল বহন করে প্রতিদিন ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা আয় করি। পরিবারের ৩ সদস্যের জন্য চাল, ডাল, তেল কিনতেই এই টাকা শেষ হয়ে যায়। ছুটির দিনগুলোতে ভ্যান বের করা যায় না। ৫০ টাকার নিচে বাজারে কোন চাল পাওয়া যাচ্ছে না। গরীবের দুঃখ-কষ্ট কেউ দেখে না। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

পার নওগাঁ মহল্লার বাসিন্দা সংগ্রাম হোসেন বলেন, একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে যে বেতন পাই সেটা বাজার করতেই শেষ হয়ে যায়। ৩ বছর যাবত কোন সঞ্চয় করতে পারছি না। প্রতি বছর বোরো ধান কাটার পর বাজারে চালের দাম কমে। এবার সেটা হয়নি। চালের দামে কোন পরিবর্তন নেই। চালের বাজারের সিন্ডিকেট করে যারা দাম বাড়িয়ে দেয় তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

তবে ভোক্তাদের এসব অভিযোগ মানতে একেবারেই নারাজ খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহরের পৌর চাল বাজারের একাধিক খুচরা চাল ব্যবসায়ী বলেন, খুচরা পর্যায়ে চাল বিক্রির ক্ষেত্রে বাজারে কোন সিন্ডিকেট নেই। যত সিন্ডিকেট সব আড়ত ও মিলারদের মধ্যে হয়। বাজারে মোটা চালের সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ অনেক মিলার ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে মোটা চাল মজুত রয়েছে। যা প্রশাসনের অভিযানে খুঁজে বের করা সম্ভব। চালের অবৈধ মজুতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই বাজারে স্বস্তি ফিরবে।

সৌরভ খাদ্য ভান্ডারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী সুবাস সরকার বলেন, চালের দাম দীর্ঘদিন যাবত অপরিবর্তিত রয়েছে। আবার অনেকের ঘরে নতুন ধানের চাল রয়েছে। এজন্য বাজারে কোন ক্রেতা নেই। বেশি দামে চাল কিনলে বেশি দামেই বিক্রি করতে হয়। আগে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ হাজার টাকার চাল বিক্রি হয়েছে। অথচ এখন সারাদিনে ৩ হাজার টাকার চাল বিক্রি করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

নওগাঁ ধান্য-চাউল আড়ৎদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধান কিনে চাল তৈরি করতে প্রতি কেজিতে কমপক্ষে ৪৫-৪৬ টাকা খরচ পড়ছে মিল মালিকদের। সেই দিক বিবেচনায় ভোক্তা পর্যায়ে ৫০ টাকা কেজিতে চাল কিনে খাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এই দামে পাইকারী ব্যবসায়ীরা এখনো চাল বিক্রি করতে পারছে না। মোকামে চাহিদা না থাকায় প্রতি কেজিতে ১-২ টাকা লোকসান দিয়ে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। এখানে কোন সিন্ডিকেট কাজ করছে না।

তিনি বলেন, বর্তমানে জেলার সমস্ত ট্রাক আম পরিবহনে ব্যস্ত সময় পার করছে। আমের ক্ষেত্রে ভাড়াও চড়া পাচ্ছে ট্রাক মালিকরা। সেই ক্ষেত্রে পরিবহন সংকট দেখা দেওয়ায় ঢাকায় চাল পাঠাতে গিয়ে ১৩-১৪ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫-২৬ হাজার টাকা পরিবহন খরচ হচ্ছে। এতে বাহিরের মোকামগুলোতে চালের দাম বেড়েছে। কিছুদিনের মধ্যে আম পরিবহনের চাপ কমলে ট্রাকের ভাড়া কমবে এবং ঢাকার মোকামে চালের চাহিদা বেড়ে যাবে। তবে ওই মুহুর্তে নওগাঁ মোকামে প্রতি কেজি চালের দাম ১-২ টাকা বেড়ে যাবে। এখানে নওগাঁ মোকামে চালের দাম বৃদ্ধির সাথে ঢাকায় চালের দামে হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। যতটুকুই বাড়বে, তা পরিবহন ভাড়ায় সমন্বয় হবে।

নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ তানভীর রহমান বলেন, মজুদ নীতিমালা লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ধান-চাল মজুতের সুযোগ নেই। চালের বাজারের অস্থিতীশলতা দূর করতে শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে। অভিযানে কারোর কাছে অবৈধ মজুত পেলে তাঁদের লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

Recommended For You