আজ সাকরাইন উৎসব, ঘুড়িতে ছেয়ে যাবে ঢাকার আকাশ

বাঙালির ঐতিহ্যবাহী উৎসব পৌষ সংক্রান্তি। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসবটি উদযাপন করা হয়। সাধারণত ‘পৌষসংক্রান্তি’ অথবা শুধু ‘সংক্রান্তি’ নামেই অনেকে এ উৎসবকে চিনেন। কিন্তু পুরান ঢাকার মানুষের কাছে এটি ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব।

সাধারণত পৌষ মাসের শেষ দিনে ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব আয়োজন করা হয়। তবে বাংলা ক্যালেন্ডার ও পঞ্জিকা তারিখের সঙ্গে কিছুটা পার্থক্যের কারণে… প্রতিবছর দুদিনব্যাপী এই উৎসবটি পালন করেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা।

এই উৎসবটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হলেও বহু বছর ধরে পুরান ঢাকায় সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব। পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে এদিন পুরান ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে সাকরাইন উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। শুরু হয় ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা।

ছোট বড় সবার অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে উঠে প্রতিটি বাড়ির ছাদ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে বাড়তে থাকে ঘুড়ির সংখ্যা ও উৎসবের মুখরতা।.. সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে পুরান ঢাকার আকাশে শোভা পায় নানা রঙ আর বাহারি আকৃতির ঘুড়ি। এছাড়া আগুন নিয়ে খেলা, আতশবাজি ফোটানো এ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ।

সাকরাইন উৎসবকে ঘুড়ি উৎসবও বলা হয়। এ উৎসবে অংশ নেন সব ধর্ম, পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ।

সাকরাইন উৎসব এর আদি কথা : ঢাকায় পৌষসংক্রান্তির দিনকে বলা হয় সাকরাইন। আদি ঢাকাই লোকদের কাছে পিঠাপুলি খাবার উপলক্ষ আর সঙ্গে ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতার দিন। সাকরাইন একান্তই ঢাকার, যুগের পরিক্রমায় তাদের নিজস্ব উৎসব। এটা বাংলাদেশের অন্য কোথাও পালিত হয় না। যা ঢাকার জনপ্রিয় ও দীর্ঘ সাংস্কৃতিক চর্চার ফল।

সাকরাইন শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রাণ’ থেকে এসেছে। আভিধানিক অর্থ : বিশেষ মুহূর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মুহূর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকেই বলা হয় সাকরাইন। এই সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব…এশিয়ায় অনেক দেশেই এই উৎসব পালন করে। তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে। এই উৎসবের দুটো দিক আছে। একটি ধর্মীয় অপরটি সাংস্কৃতিক।

সংক্রান্তির এই উদযাপন কবে থেকে চলে আসছে তা সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। হতে পারে হাজার বা তারও আগের পুরোনো এ মকর সংক্রান্তির মহাতিথি।মকর সংক্রান্তি বা পৌষ মাসের শেষ দিন হিন্দু জমিদারেরা তাদের জমিদারিতে ব্রাহ্মণ ও প্রজাদের আতিথেয়তা দেন। উন্মুক্ত মাঠে ভোজ উৎসব হয়। বিতরণ করা হয় চাল, গুড়, তেলের তৈরি পিঠা ও ডাবের পানি। এটি বাস্তু পূজা নামে পরিচিত। এ উপলক্ষে বিক্রমপুরে কুস্তি, লম্বদান ইত্যাদি প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এই হলো সংক্রান্তির ধর্মীয় দিক।

সাকরাইন ঢাকার বিশেষ ঘুড়ি উৎসব। আদিকাল থেকেই এ শহরের মানুষ ঘুড়িবাজ হিসেবে পরিচিত। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। এখানে ঘুড়ি উড়ানোর পেশাদারিত্ব কারুকাজ ও কলাকৌশলে অবাক হয়ে ঐতিহাসিকেরাও এর মুগ্ধতা প্রকাশ করে গেছেন।

সাকরাইনে একটা ঘুড়ি ভোঁকাট্টা হলেই ভোঁ-দৌড়। যে আগে পৌঁছাতে পারবে, ঘুড়িটা তার। একসময় পৌষের শেষে পুরান ঢাকার জামাইরা শ্বশুরবাড়ি এলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো ঘুড়ি ও নাটাই। সব বাড়ির জামাই ঘুড়ি উড়ালে ঘটা করে সেসব দেখতেন গ্রামবাসী। এমনটা এখন আর হয় না। কিন্তু উৎসবটা রয়ে গেছে। কালের ধারাবহিকতায় উৎসবে… অনুষঙ্গের পরিবর্তন এলেও আমেজ ও আবেগটা কিন্তু এখনও প্রজন্মান্তরে রয়ে গেছে ঠিক আগের মতোই। শত বছরের নানা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত উত্তেজনার মাঝেও পৌষসংক্রান্তি এই শহরে হিন্দু মুসলিম সবার সর্বজনীন এক সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে আজও টিকে আছে।

পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাকরাইন উৎসব ঘিরে বিক্রি হচ্ছে নানা রকমের ঘুড়ি। এদের মধ্যে চশমাদার, কাউটাদার, পঙ্খিরাজ, প্রজাপতি, চক্ষুদার, ঈগল, সাদা ঘুড়ি, চারবোয়া, দুই বোয়া, টেক্কা, লাভ ঘুড়ি, ৩ টেক্কা, মালাদার, দাবা ঘুড়ি, বাদুর, চিল, অ্যাংরি বার্ডসহ নানা আকৃতির ঘুড়ি।

উল্লেখ্য, শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল থেকে শুরু হয়েছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব।

ডব্লিউজি/এআর

শেয়ার করুন:

Recommended For You