আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া মহারণ আজ

এর আগে যতবার বিশ্বকাপ ফুটবলের শেষ চারে উঠে এসেছে আলবিসেলেস্তারা, ততবারই ফাইনালে খেলার টিকিট কেটেছে। কাতার বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে হট ফেভারিট হয়েই মাঠে নামছে লিওনেল মেসির দল। আর এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ সবসময়ের লড়াকু দল হিসেবে খ্যাত ক্রোয়েশিয়া।

কাতারের রাজধানী দোহার লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় আজ রাত ১টায় ম্যাচটি মাঠে গড়াবে। ম্যাচে মেসি, মার্টিনেজরা ফেভারিট হলেও তাদেরকে হারানোর হুঙ্কার ছেড়েছে ক্রোয়েশিয়াও। টানা দ্বিতীয়বার ফাইনালে খেলার হাতছানি মদ্রিচদের সামনে। রাশিয়া বিশ্বকাপেও ফাইনাল ম্যাচ খেলেছিল লুকা মদ্রিচের দল।

আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া দু’দলই অনেকটা ভাগ্যকে সঙ্গী করে সেমিফাইনালে উঠে এসেছে। ক্রোয়েশিয়া কোয়ার্টার ফাইনালে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে সেরা চারে উঠে এসেছে। ঠিক তেমনি কোচ লিওনেল স্কালোনির আর্জেন্টিনাও টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে সেমির টিকিট কেটেছে।

ভাগ্যের পরশ নিয়ে সেমিতে আসা দু’দলই জয়ের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। যে কারণে আরেকটি হাড্ডাহাড্ডি ও উপভোগ্য ম্যাচ হবে বলে ধারণা করছেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। অনেকটা ইতিহাসের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে এবার এগিয়ে চলেছে আর্জেন্টিনা। দলটির সামনে ১৯৮৬ সালের পর অর্থাৎ ৩৬ বছর পর শিরোপা জয়ের হাতছানি। কিংবদন্তি দিয়াগো ম্যারাডোনার পর বর্তমানের আরেক কিংবদন্তি লিওনেল মেসির পরশে সে পথেই হাঁটছে বিখ্যাত আকাশি-সাদা জার্সিধারীরা। ১৯৯০ বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে হারের পরও শেষ পর্যন্ত ফাইনালে খেলেছিল আর্জেন্টিনা। এবার মরুর বুকেও গ্রুপ পর্বে সৌদি আরবের কাছে অপ্রত্যাশিত হারে মিশন শুরু হয় তাদের।

এক হারেই বিধ্বস্ত না বরং সেখান থেকে বলতে গেলে অনেকটা একক কৃতিত্বে দলকে সেমির মঞ্চে তুলে এনেছেন অধিনায়ক মেসি। রেকর্ড সর্বোচ্চ ছয়বারের ফিফা সেরা ও সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী তারকা প্রতি ম্যাচেই চোখ ধাঁধানো পারফরমেন্স প্রদর্শন করে চলেছেন। ফুটবল বোদ্ধাদের মতে, মেসি ম্যাজিক অব্যাহত থাকলে শুধু সেমিফাইনাল নয়, এবার তিন যুগ পর বিশ্বকাপই জিতে নেবে আর্জেন্টিনা। ইতিহাস ও পরিসংখ্যান বলছে, এই লড়াইয়ে আর্জেন্টিনা আগে কখনো হারেনি। প্রতিপক্ষে যে দলই হোক না কেন কাতার বিশ্বকাপের আগে কখনো শেষ চারে হারেনি ম্যারাডোনার দেশ।

আজ রাতের ম্যাচের আগে চারবার সেমিফাইনাল খেলেছে আর্জেন্টিনা। যেখানে প্রতিটি ম্যাচই জিতে ফাইনালে উঠেছে দলটি। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসরেই সেমিফাইনালে খেলেছিল আর্জেন্টিনা। এরপর ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপ, ১৯৯০ সালে ইতালি বিশ্বকাপ ও সবশেষ ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে তারা খেলেছে শেষ চারে। প্রতিটি ম্যাচেই জয় পায় আর্জেন্টিনা। এর মধ্যে ১৯৭৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হলেও সেবার টুর্নামেন্টের ফরম্যাট ছিল ভিন্ন। যে কারণে খেলতে হয়নি সেমিফাইনাল।
সব এক করলে এর আগে পাঁচবার আর্জেন্টিনা শেষ চারের বাঁধা পেরিয়ে ফাইনালে খেলেছে। এর মধ্যে দুইবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেও ফাইনালে হারতে হয়েছে তিনবার। সবশেষ ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় মেসিদের।

আর্জেন্টিনা এর আগে সব আসরেই সেমিফাইনালে কমপক্ষে দুটি করে গোল করেছে। সবমিলিয়ে এই স্টেজে তাদের গোল সংখ্যা ১৪টি। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটি যে ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে সামনে এসেছে সেটা ভালোমতোই উপলব্ধি করছে আর্জেন্টাইনরা। ক্রোয়েশিয়ার জমাট রক্ষণভাগকে কোনোভাবেই ফাঁকি দিতে পারেনি ব্রাজিলের তুখোড় আক্রমণভাগ।

পাশাপাশি গোলরক্ষক ডোমিনিক লিভাকোভিচও আছেন ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে। মেসি, মারিয়া, মার্টিনেজদের তাই চ্যালেঞ্জ আগের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার। চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপে নকআউট পর্বে নির্ধারিত সময়ে কোনো ম্যাচেই জিততে পারেনি ক্রোয়েশিয়া। ভাগ্যের পরশ সঙ্গী করে তারা সেমিফাইনালে উঠে আসে। এরপর সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের সাথে অতিরিক্ত সময়ের গোলে জিতে ফাইনালে ওঠে। চার বছর পর কাতারের বুকেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে ক্রোয়েশিয়া। শেষ আটে ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে বিদায় করার আগে শেষ ষোলোতে জাপানকেও একইভাবে বাড়ির পথ ধরিয়ে দেয়। অর্থাৎ বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত চারবার টাইব্রেকারের পরীক্ষা দিয়ে শতভাগ সফল ক্রোয়েশিয়া। এবার সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে তারা টানা ১১ ম্যাচে অপরাজিত আছে।
এই মঞ্চে জিততে পারলে ক্রোয়েশিয়া অনন্য এক রেকর্ডও গড়বে। এর আগে পরপর দুই বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার কৃতিত্ব দেখিয়েছে ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি। এই দলগুলোর চেয়েও বড় সাফল্য আছে ব্রাজিলের। সেলেসাওরা ১৯৯৪, ১৯৯৮, ২০০২ টানা এই তিন বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছিল। এর মধ্যে ’৯৮ বাদে দুইবারই চ্যাম্পিয়ন হয় সাম্বা ছন্দের দেশটি। আরেকটি পরিসংখ্যান থেকে কোচ ডালিচের দল আত্মবিশ্বাসী হতেই পারে। তারা এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে দশটি ম্যাচ খেলেছে। অবাক করা বিষয়, প্রতিটি ম্যাচেই গোল করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে ক্রোয়েটরা।

এর আগে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে দুইবার মুখোমুখি হয়েছে আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে জয় পেলেও ২০১৮ বিশ্বকাপে রীতিমতো বিধ্বস্ত হয়। সেবার মদ্রিচরা মেসির দলকে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করে। সেই দলের বেশিরভাগ ফুটবলার এবারও ক্রোয়েট দলে আছে। যে কারণে আরেকবার মেসিদের বিরুদ্ধে জয়ের আশা করছে দলটি। এই মিশনে ক্রোয়েশিয়া চোটমুক্ত সেরা দলই পাচ্ছে।

অসুস্থতা কাটিয়ে বোর্না সোসা ও মিসলাভ ওরসিচ দলে ফিরছেন। তুলনায় আর্জেন্টিনা কিছুটা হলেও বেকায়দায় আছে। কোয়ার্টার ফাইনালে হলুদ কার্ড পাওয়ায় টানা দুই কার্ডে দুই ফুল ব্যাক গঞ্জালো মনটিয়েল ও মার্কোস অ্যাকুনা খেলতে পারছেন না মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। রাইট ব্যাক পজিশনে মনটিয়েলের জায়গায় নাহুয়েল মোলিনা ও অ্যাকুনার পজিশনে নিকোলাস টাগলিয়াফিকোর খেলার সম্ভাবনা বেশি। তবে স্বস্তির জায়গাও আছে কোচ স্কালোনির। গোড়ালির ইনজুরি কাটিয়ে দলে ফিরেছেন আলেজান্দ্রো গোমেজ। রডরিগো ডি পল ও অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া সেমিফাইনালের আগে পরিপূর্ণ ফিটনেস ফিরে পাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

বিশ্বকাপের মতো সবমিলিয়ে পরিসংখ্যানেও সমানে সমান আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া। দু’দল এখন পর্যন্ত পরস্পরের বিরুদ্ধে খেলেছে পাঁচটি ম্যাচ। যেখানে দুটি করে জয় দু’দলেরই। আরেকটি ম্যাচ ড্র হয়। এবার আর্জেন্টাইন অধিনায়ক মেসির সামনে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলার হাতছানি। ২০১৪ সালে ফাইনালে উঠলেও জার্মানির কাছে হারতে হয়েছিল। ক্লাব ও জাতীয় দল মিলিয়ে সম্ভাব্য সব ট্রফি জিতেছেন খুদে জাদুকর।

কেবল বিশ্বকাপই জেতা হয়নি। এবার সেই অপূর্ণতা ঘোচাতে আর মাত্র দুই জয় প্রয়োজন আর্জেন্টিনার। তবে কাজটা যে সহজ হবে না সেটা বলাইবাহুল্য। সেমির প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়াই রীতিমতো হুঙ্কার দিয়ে রেখেছে। ২০০২ সালে ব্রাজিলের পর প্রথম দল হিসেবে টানা দ্বিতীয়বার ফাইনালে খেলার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায়না মদ্রিচ বাহিনী। এটা করতে হলে প্রতিপক্ষের তারকা মেসিকে অকেজো করার বিকল্প নেই।

ডব্লিউজি/এমএ

শেয়ার করুন:

Recommended For You