থেমে গেল ঐন্দ্রিলা জীবন

হাসপাতালের বিছানায় লড়াই করছে ‘শিউলি’। শ্বাসপ্রশ্বাস ওঠানামা করছে। হাল ছেড়ে দিয়েছে মা-বাবা। কিন্তু আশা ছাড়েনি ‘ড্যান’। তার বিশ্বাস, এই লড়াই জিতে ঠিক ফিরে আসবে শিউলি। এই আবহেই নিজের ছবি ‘অক্টোবর’-এর চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন পরিচালক সুজিত সরকার। ২০১৮ সালের এপ্রিলে মুক্তি পেয়েছিল বরুণ ধবন-বনিতা সাঁধু অভিনীত সেই ছবি বক্স অফিসে মারকাটারি সাফল্য পেয়েছিল কি? চার বছর পর খুব বেশি কেউ মনে করতে পারবেন না। কিন্তু অনেকের মনে থাকবে অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মার জীবন এবং হাসপাতালের রোগশয্যায় সেই লড়াইয়ের কাহিনি। সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো। গল্পের মতো।

১৯৯৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে জন্ম। উচ্চবিত্ত পরিবারের কন্যা। মা, বাবা, দিদিকে নিয়ে তাঁর আপনজনের বৃত্ত। কিন্তু ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঐন্দ্রিলার ১৭ বছরের জন্মদিনে এই কিশোরী জানতে পারেন, কঠিন রোগ বাসা বেঁধেছে তাঁর শরীরের অস্থিমজ্জায়। কর্কট রোগ। ক্যানসার। তখন ঐন্দ্রিলা একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। দিল্লিতে শুরু হয়েছিল সুস্থ হয়ে ওঠার লড়াই। প্রথম তিন দিনেই ৬০টা ইনজেকশন! ছাপার ভুল নয়…, ষাটটা! ভাবা সত্যিই কঠিন। কিন্তু হাল ছাড়েননি ঐন্দ্রিলা। তাঁর দিদি চিকিৎসক। তখন চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ছিলেন দিল্লিতেই। সেই শুরু ঐন্দ্রিলার এক অন্য যাত্রা। পর পর কেমোথেরাপি। পর পর ওষুধ। তাঁর মতো ১৭ বছর বয়সি ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলের মাঠে, পড়ার টিউশনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন একের পর এক মুহূর্ত অনিশ্চয়তায় কেটেছে কিশোরী। চিকিৎসকেরা সময় দিয়েছিলেন ছ’মাস। আর ঐন্দ্রিলা বুঝে গিয়েছিলেন জীবন-মৃত্যুর মধ্যে নিহিত সেই সময়ের সত্য। বুঝেছিলেন, আর ছ’মাস! মাত্রই ছ’মাস রয়েছে তাঁর হাতে।

ফাইল চিত্র। প্রতি মুহূর্ত একটা চিন্তাতেই কাটত— পর দিন সকালটা আসবে তো জীবনে? খাতা-বই নয়, তখন তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে ছিল হুইলচেয়ার। কেমোথেরাপির ফলে মাথার চুল, ভ্রু প্রায় নেই। শরীরও খানিক বিকৃত। বাড়ির বাইরে বেরনোই কঠিন ছিল ঐন্দ্রিলার। শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশিই ছিল মানসিক টানাপড়েন। অশান্তি। কিন্তু জীবনের সেই লড়াইয়ে জিতে গিয়েছিলেন ঐন্দ্রিলা। টানা দেড় বছর যুদ্ধ চালিয়ে ২০১৬ সালে…রোগমুক্ত হয়ে ফের জীবনে ফিরেছিলেন শিখা শর্মা-উত্তম শর্মার কনিষ্ঠা কন্যা। ঐন্দ্রিলার স্বপ্ন ছিল। অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নও সফল করেছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে ছোট পর্দায় সেই জীবনে হাতেখড়ি হয়েছিল ঐন্দ্রিলার। ‘ঝুমুর’ ধারাবাহিকে শুরু হয়েছিল অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলার যাত্রা। অল্প সময়ে দর্শকেরা ভালবেসেছিলেন তাঁকে।

তত দিনে জীবনে জীবন জুড়েছে। ঐন্দ্রিলার জীবনে এসেছেন অভিনেতা সব্যসাচী চৌধুরী। ‘ঝুমুর’ ধারাবাহিক থেকেই শুরু তাঁদের বন্ধুত্বের। পৃথিবীর অনেক বন্ধুত্বের মতো সেই সম্পর্কও প্রেমে গড়িয়ে গিয়েছিল। ধারাবাহিক শেষ হয়েছিল। শুরু হয়েছিল নতুন সম্পর্ক।/কিন্তু ঐন্দ্রিলার জীবন তো লড়াই ছাড়া থাকতে পারে না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার ডান হাত থেকে ঘাড় পর্যন্ত অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হয়। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানতে পারেন, ফুসফুসে ১৫ সেন্টিমিটারের একটি টিউমার তৈরি হয়েছে। আবার শুরু বাঁচার লড়াই। তফাত একটাই— সে বারে সর্বক্ষণ পাশে ছিলেন সব্যসাচী।

২০২২ সালে আবার যুদ্ধজয় করে ছন্দে ফেরেন ঐন্দ্রিলা। আবৃত্তি করতে, নাচতে ভালবাসতেন। দ্বিতীয় বার ক্যানসার জয় করে ফেরার পর নাচতে অসুবিধা হত। কিন্তু মনের অবিমিশ্র জোরে ফিরেছিলেন ধারাবাহিকের অভিনয়ে। ‘জিয়ন কাঠি’ ঐন্দ্রিলার অন্যতম জনপ্রিয় কাজ। ‘ভাগাড়’ নামক একটি ওয়েব সিরিজেও অভিনয় করেন। ‘ভাগাড়’-এর সাফল্যের পর আরও একটি ওয়েব সিরিজে কাজ করার কথা ছিল। কথা ছিল গোয়ায় শুটিং করতে যাবেন ইউনিটের সঙ্গে। কিন্তু তার আগেই আচমকা আবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হন ঐন্দ্রিলা।

এ বার আর ফিরলেন না তিনি। ২৪ বছরেই থেমে গেল তাঁর জীবন। যেমন ‘অক্টোবর’ ছবিতে ফেরেনি শিউলি। ড্যানের পরিচর্যায় সুস্থ হয়ে গিয়েও পরে অসুস্থ হয়েছে। তার পর দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে। তখন অবশ্য তার পাশে ছিল না ড্যান। ‘অক্টোবর’-এর কাহিনিকার..শেষ সময়ে শিউলির পাশে রেখেছিলেন তার বন্ধু ড্যানকে। নভেম্বরের কাহিনিতে ঐন্দ্রিলার পাশে ছিলেন সব্যসাচী। সমাপতন। কিন্তু এক আশ্চর্য সমাপতন। জীবন কখনও কখনও সিনেমার মতোও হয়ে যায়। সূত্র আনন্দবাজার পত্রিকা

ডব্লিউজি/এআর

শেয়ার করুন:

Recommended For You