৯০ দশকে আমারা যারা শৈশব কাটিয়েছি, তাদের কাছে আইয়ুব বাচ্চু একটা অনুভূতির নাম, একটা ভালোবাসার নাম। তখন সিডি ক্যাসেটের প্রচলন ছিল। আমাদের শহরের পৌর মার্কেটে বাবুল স্টুডিও ছিল সব চেয়ে বড় সিডি ক্যাসেটের দোকান। ঢাকা এলে ধানমন্ডির নিউমার্কেটের মেইন রোডের সঙ্গেই বেশ কয়েকটা স্টুডিও ছিল। সেখান থেকে আয়ুব বাচ্চুর সিডি কিনতাম। কত রোমাঞ্চকর ছিল সেই সময়টা। আইয়ুব বাচ্চু মানেই ছিল ভালোবাসা এবং ভালো লাগার নাম। আজ এই রূপালী গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চুর ৬০ তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা ব্যান্ড সংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। শ্রোতা এবং দর্শকদের হৃদয় জুড়ে এখনো তার বিচরন নক্ষত্রের আলোর মতই উজ্জ্বল৷ ফেলে যাওয়া রুপালি গিটারের কাব্যময়তার প্রতীক আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৬২ সালের ১৬ ই আগষ্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা রক সংগীতের এই কিংবদন্তি শিল্পী। তার বাবা ইশহাক চোধুরী এবং মা নুরজাহান বেগম।
কলেজে জীবনে বন্ধুদের নিয়ে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ নামে একটা ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন আইয়ুব বাচ্চু। পরে অবশ্য এর নাম পাল্টে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। বিয়েবাড়ি, জন্মদিন আর ছোটখাটো নানা অনুষ্ঠানে গান করতো তাদের এই ব্যান্ডদল। আইয়ুব বাচ্চুর বন্ধুরা যে যার মতো একেক দিকে ছড়িয়ে পড়েন। এরপর আইয়ুব বাচ্চু ব্যান্ডদল ‘ফিলিংস’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান।
১৯৮০ সালে আইয়ুব বাচ্চু ও কুমার বিশ্বজিৎ একসঙ্গে দেশের জনপ্রিয় এবং পুরনো ব্যান্ডদল ‘সোলস’-এ যোগ দেন। তার প্রথম গাওয়া গান হারানো বিকেলের গল্প। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাচ্চু সোলস ব্যান্ডের সঙ্গে থাকতে পেরেছিলেন। কারণ ওই বছরই দলটি ভেঙে যায়। পরের বছর তিনি লাভ রানস ব্লাইন্ড অর্থাৎ এলআরবি ব্যান্ডদল গঠন করেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই দলটির মেইন ভোকাল ছিলেন। তার প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম রক্তগোলাপ। তবে তার সফলতা শুরু হয় দ্বিতীয় অ্যালবাম ময়নার মাধ্যমে। এদিকে আইয়ুব বাচ্চুর এলআরবি ১৯৯২ সালে এলআরবি ১ এবং এলআরবি ২, বাংলাদেশের প্রথম ডবল অ্যালবাম প্রকাশ করেছিল। তাদের তৃতীয় অ্যালবাম সুখ (১৯৯৩) ছিল অন্যতম ব্যবসা সফল অ্যালবাম।
৪০ বছরের গায়কী জীবনে ১২টি ব্যান্ড, ১৬টি একক ও বহু মিশ্র অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুর। এসবের পাশাপাশি গান গেয়েছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও। তার অসংখ্য দর্শকপ্রিয় গানের তালিকায় সুখ, একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ ফেরারি মন এই রুপালি গিটার হাসতে দেখো, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, চলো বদলে যাই সহ আছে বহু নাম।
তার প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে ‘রক্তগোলাপ নামে’। আর এলআরবির প্রথম অ্যালবাম হলো ‘এলআরবি’ (১৯৯২)। এরপর ‘ব্যান্ডের সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘ফেরারী মন’, ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০০), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নেই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ’ (২০১২) প্রকাশিত হয়।
একক অ্যালবামের মধ্যে রক্তগোলাপের পর রয়েছে ‘ময়না’ (১৯৮৮), ‘কষ্ট’ (১৯৯৫), ‘সময়’ (১৯৯৮), ‘একা’ (১৯৯৯), ‘প্রেম তুমি কি!’ (২০০২), ‘দুটি মন’ (২০০২), ‘কাফেলা’ (২০০২), ‘প্রেম প্রেমের মতো’ (২০০৩), ‘পথের গান’ (২০০৪), ‘ভাটির টানে মাটির গানে’ (২০০৬), ‘জীবন’ (২০০৬), ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’ (ইন্সট্রুমেন্টাল, ২০০৭), ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ (২০০৮), ‘বলিনি কখনো’ (২০০৯), ‘জীবনের গল্প’ (২০১৫)।
তাছাড়াও অনেক মিশ্র অ্যালবামে কাজ করেছেন আইয়ুব বাচ্চু। ব্যান্ড এলআরবি ও ফিলিংস নব্বইয়ের দশকে যৌথভাবে ‘ক্যাপসুল’ ও ‘স্ক্রু ড্রাইভার’ নামে অসম্ভব শ্রোতাপ্রিয় দুটি অ্যালবাম উপহার দেন। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর রুপালি গিটার ফেলে আকাশে উড়াল দিয়েছেন সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। হঠাৎ তার উড়ে যাওয়া কেউ-ই মেনে নিতে পারেননি।
ডব্লিউজি/এমএ