পাইকারি ক্রেতা সংকট: ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত নরসিংদীর চাষীরা

জালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নরসিংদীর পাইকারী সবজির বাজারগুলোতে। সবজির সরবরাহ থাকলেও নেই পাইকারী ত্রেতা, ফলে উৎপাতি সবজি বাজারে নিয়ে বিপাকে চাষীরা। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাধ্য হয়ে নামমাত্র মুল্যে সবজি বিক্রি করছেন কৃষকরা। এখানকার সবজির হাটে ঢাকা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা ট্রাক নিয়ে আসতেন সবজি নিতে। তবে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি হওয়ায় সবজির বাজারগুলোতে স্থানীয় পাইকার ছাড়া জেলার বাহিরের পাইকার কমেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নরসিংদীর সবজির কদর দেশজুড়ে। জেলায় এ বছর সবজির আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ৩৬ হেক্টর জমিতে। জেলায় সবচেয়ে বেশি সবজি চাষ হয় শিবপুর, বেলাব, রায়পুরা ও মনোহরদী উপজেলায়। উৎপাদিত সবজি বেলাব উপজেলার বারৈচা ও নারায়ণপুর, রায়পুরা উপজেলার জঙ্গি শিবপুর ও মরজাল, শিবপুর উপজেলার শিবপুর, পালপাড়া, যোশর , সৃষ্টিগড় ও কোন্দারপাড়া পাইকারি সবজি হাটে বিক্রি করতে নিয়ে আসেন কৃষকরা। পরে পাইকারি ক্রেতারা স্থানীয় বাজার থেকে সবজি কিনে রাজধানী ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ , চট্ট্রগ্রাম ও সিলেট জেলায় নিয়ে যায় ট্রাকে করে। এই জেলার সবজি সারাদেশে ৪০শতাংশ চাহিদা পূরণ করে আসছে। ভালো মানের সবজি রপ্তানীও দেশের বাহিরে। তবে গত কয়েকদিনে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। জালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর পরিবহন খরচ লাগছে দ্বিগুণ। সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবহন সংকটও।

পাইকারী ক্রেতারা বলছেন, “পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত খরচের কারণে লোকসানের শংকা বাড়ছে। তাই সবজি কেনায় আগ্রহ কমছে। এ কারণে হাটগুলোতে বিক্রি কমেছে। সরেজমিনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর সবজির হাটে দেখা যায়, উপজেলার আশেপাশের এলাকা থেকে সবজি চাষীরা ভ্যান ও রিক্সায় ঝুড়ি ভর্তি বিভিন্ন ধরনের সবজি নিয়ে হাটে আসছেন। কৃষকরা পাইকারী হাটে প্রতি মণ বেগুন এক হাজার থেকে ১২শত টাকা, করলা দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা, কাকরোল ৮শত থেকে এক হাজার টাকা, বরবটি এক হাজার থেকে ১২ টাকা, ঢেড়শ এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা, ঝিঙ্গা এক হাজার টাকা, পেঁপে ৪শত থেকে ৫শত টাকা বিক্রি করছে। এছাড়া প্রতি পিছ লাউ আকার ভেদে ২০ থেকে ৩০ টাকা ও ঝালি কুমড়া ১৫ থেকে ২২০ টাকা বিক্রি করছে। তবে উৎপাদন খরচের তুলনায় ন্যায্য দাম না পেয়ে সবজি বিক্রি করায় বিপাকে কৃষকরা।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, নরসিংদী জেলায় উৎপাদিত সবজির খ্যাতি রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে। এখানকার উৎপাদিত সবজির প্রায় ৪০ ভাগই সরবরাহ করা হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে, রপ্তানী হয় বিদেশেও। বর্তমানে জেলার ৯টি পাইকারী বাজারেই সরবরাহ আছে লাউ, পটল, পেপে, কাকরোল, বরবটি, ঢেরস, বেগুনসহ বিভিন্ন শাক-সবজি। তবে জালানী তেল বৃদ্ধির প্রভাবে পাইকারী ক্রেতার সংখ্যা কম থাকায় লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের।

গোসাই চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমরা সারাবছর শাক-সবজি উৎপাদক করি। ফলন ভালো হলে দাম কম পায় আর ফলন কম হলে দাম বেশি পাই। তবে যে দাম পায় তা নামমাত্র মূল্য, সঠিক মূল্য পাওয়া আমাদের কাছে খুব কঠিন। যে সব সবজি আমরা ১৫ থেকে ২০ টাকা বিক্রি করি সেই সবজি ঢাকা গেলে হয়ে যায় ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। তিন থেকে চারগুন বেড়ে যায়। আমরা কখনই লাভবান হতে পারিনি আর পারবোও না। সারা বছর সবজি বেঁচে যা টাকা আসে তা দিয়ে সংসার চলে।’

তিনি আরো বলেন, ‘বছর শেষে সার আর ঔষদের দোকানের ঋনের টাকা এনজিও থেকে টাকা তুলে তাদেরকে দিতে হয়। সরকার আমাদের না সরকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের জন্য। আমরা যদি সবজি উৎপাদন বন্ধ করে দেই তাহলে সরকার অন্য দেশ থেকে সবজি আনবে বেশি দামে তখন সরকার টের পাবে। নিত্য দিনের সামগ্রীসহ জালানী তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার শুধু সাধারণ মানুষকে নয় কৃষকেও মেরে ফেলার চেষ্টা করছে।’

সবজি বিক্রেতা আমীর হোসেন বলেন, ‘জালানী তেল বৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ দ্বিগুন দেখিয়ে পাইকাররা সবজি কিনে নিচ্ছেন নামমাত্র মূল্য দিয়ে। পরিবহন সংকটসহ নানা কারনে অল্প পরিসরে সবজি ক্রয় করে তারা পাঠাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। যেখানে প্রতি কেজি বেগুনের দাম মাত্র ২৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা। কাকরোল ২০-২৫ টাকায় ও বরবটি বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়। এতে করে চলতি মৌসুমে চরম ক্ষতির মুখে আমামেদর মতো হাজারোও কৃষকেরা, এসময়ে আমাদের লোকশান পুষিয়ে দিতে সরকারী সহায়তা একান্তভাবে সহযোগিতা কামনা করছি।’

হাটে সবজি কিনতে আসা পাইকারি ক্রেতা আফাজ উদ্দিন বলেন, ‘আগে সিলেটের গাড়ির ভাড়া ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা দিয়ে সবজি নিয়ে যেতাম। এখন দিতে হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। যার ফলে আমাদের সবজির দাম ও বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। গাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির কারণে সবজি কেজি প্রতি ৪ থেকে ৬ টাকা দাম বেড়েছে।’

আরেক পাইকারি ক্রেতা জুয়েল বলেন, ‘জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের গাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে দ্বিগুণ। কিন্তু কমদামী সবজি ক্রয় করেও কৃষকদের দলবদ্ধ ভাবে বিপনণ ব্যবস্হা গড়ে তোলার জন্য আমরা কাজ করতেছি। ৭ থেকে ৮ জন কৃষক মিলে একটি ট্রাক ভাড়া করে সহজেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় পণ্য পাঠাতে পারবে। যার ফলে তাদের খরচ কমে যাবে। এছাড়া আমরা কৃষকদের পণ্য পরিবহনের জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ট্রাকের ব্যবস্হা করার চেষ্টা করতেছি। এটি চালু হলে কৃষকদের দুর্ভোগ অধিকাংশে কমে যাবে।’

ডব্লিউজি/এমএ

শেয়ার করুন:

Recommended For You

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *