মামুন ও টিপু গ্রুপের দ্বন্দ্ব: দুই বছরে ৮ খুন (ভিডিও)

ঝিনাইদহ শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নের ভাটবাড়িয়া গ্রামের ভিতর একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে সারিসারি কাঁচা পাকা ভাঙ্গা ঘরের স্তুপ পড়ে আছে। দেখে মনে হয়, কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের চিত্র। বাড়ির উঠানগুলোতে জমে গেছে বন জঙ্গল মনে হয় শত বছরেও কখনো মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়েনি।

ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের বছর খানেক আগে সারুটিয়া ইউনিয়নের ভাটবাড়িয়া গ্রামে আওয়ামীলীগের মামুন ও টিপু গ্রুপের কর্মীদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে সুফিয়া বেগম নামের এক নারীর বুকে ফালা ( বল্বম) বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা টিপুর সমর্থক ছিলেন। তার মৃত্যুর ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুনসহ ৬৪ জনের নামে শৈলকুপা থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। সুফিয়ার মৃত্যুর পর ভাটবাড়িয়া গ্রামের ৩০/৪০ টা বাড়ি ভাঙচুর করা হয়। লুঠ তারাজ চালানো হয় আরো ৫০/৬০ টি বাড়িতে। সুফিয়া বেগম হত্যার শিকার হয় সকালে এবং ঐ দিন বিকালে বৃত্তি বাখরবা গ্রামের পাইলট রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। পাইলট নিজ গ্রামে দুই দল গ্রাম বাসীর সংঘর্ষে আহত হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি ছিলেন। নিহত পাইলট ইউপি চেয়ারম্যান মামুনের সমর্থক ছিলেন। পাইলটের মৃত্যুর ঘটনায় নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ৭০/৮০ জনকে আসামী করে শৈলকুপা থানায় আরো একটি হত্যা মামলা করা হয়।

এর পর ৫ ই জানুয়ারি ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো অশান্ত হয়ে উঠে সারুটিয়া ইউনিয়ন। ইউপি চেয়ারম্যান মামুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পত্র পাওয়ার পর মোটরসাইকেল বহর নিয়ে ইউনিয়নের কাতলাগাড়ি বাজারে প্রবেশ করলে বিদ্রোহী প্রার্থী টিপুর সমর্থকরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় মামুনের মোটরসাইকেল বহরে। এতে ৫ টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এর পর মামুনের সমর্থকরা বিভিন্ন গ্রামে ৩/৪ টি বাড়ি ভাঙচুর করে। এর ৪/৫ দিন পর টিপুর সমর্থকরা মোটরসাইকেল বহর নিয়ে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ভোট চেয়ে কাতলাগাড়ি বাজারের দিকে আসছিলো, পথের মাঝে হামলা করে ৭/৮ টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার রেশ ধরে ঐ দিন সন্ধ্যার পর বিদ্রোহী প্রার্থী টিপুর সমর্থকরা ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর, মৌকুড়ি, বাখরবা, কৃত্তিনগর গ্রামে মধ্য যুগীয় কায়দায় হামলা করে প্রায় শতাধিক বাড়ি ঘর ভাঙচুর ও লুট তারাজ করেন। পরের দিন সংবাদ কর্মীদের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার প্রথম যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয় সেখানে। গিয়ে মনে হয় সদ্য শেষ হওয়া কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ। ধ্বংস স্তুপের উপর দাড়িয়ে যখন ফেসবুকে লাইভ করছিলাম তখন অনেক বার হত্যার হুমকিও পেয়েছি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিধবা মহিলার ঘর ও শেষ সম্বলো সেদিন রক্ষা পাইনি টিপু বাহিনীর কাছে।

এই ঘটনা নিয়ে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ইউনিয়নের ২১ গ্রামেই। এই সব ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা অনেকটাই নিরব দর্শকের মত ছিলো বলে অনেকে অভিযোগ করেন। আবার কখনো তাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করতে দেখা গেছে। ধ্বংসলিলা চলা রাতে ভুক্তভোগী পরিবার গুলো একাধিক বার ৯৯৯ এ কল দিয়ে পুলিশের সাহায্য চাইলেও পুলিশ এসেছে অনেক পরে। তাই পুলিশের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিভিন্ন মহল।

এর পরের দিন কৃষ্ণনগর গ্রামের মেম্বারের বাড়ির সামনে থেকে ৪/৫ জনে ধরে বেধড়ক মারপিট করে বৃদ্ধ কৃষক রহিম শেখকে। তাকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় ৷ এর ২ দিন পর বিদ্রোহী প্রার্থী টিপুর সমর্থকরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কাতলাগাড়ি বাজারে মহড়া দেয় এবং সন্ধার কিছু সময় পর সংঘর্ষ শুরু হয় নৌকার সমর্থকদের সাথে। সংঘর্ষ চলে প্রায় ২ঘন্টা ধরে তবু ও পুলিশ অজানা কারণে শৈলকুপা থানা থেকে এসে পৌঁছাতে পারেনি ৬ কি.মি. দূরে কাতলাগাড়ি বাজারে। ঐ দিন রাতে নৌকার অফিস, বঙ্গবন্ধু ও শেখহাসিনার ছবি ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগ করেন টিপুর সমর্থকরা।

ঐ ঘটনায় হারান নামের আওয়ামী লীগের এক সমর্থক খুন হয় এবং আহত হয় অখিল নামের আরো এক আওয়ামী লীগের কর্মী। হারান হত্যার ঘটনায় বিদ্রোহী প্রার্থী টিপু সহ ১৯০ জনের নামে হত্যা মামলা করা হয় শৈলকুপা থানায়।

ডব্লিউজি/এমএ

শেয়ার করুন:

Recommended For You

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *