বন্যায় ভেসে গেছে ২৫ হাজারের অধিক পুকুরের মাছ

দু-দফা বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য সম্পদের। যা অতীতে কখনোই মাছচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হননি। প্রথম দফা বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ কম হলেও দ্বিতীয় দফায় জেলার পূর্বের সকল রেকর্ড অতিক্রম করে মাছ চাষীদের পথে বসিয়ে দিয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দফা বন্যায় সবকিছু হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে তাদের। ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষিদের পুনর্বাসনের জন্য প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। প্রণোদনা পেলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এবং মাছের উৎপাদনবৃদ্ধি পাবে। মানুষের পুষ্টি চাহিদাও পূরণ হবে।

ভয়াবহ এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মাছ চাষীদের সরকারী সহায়তা না পেলে পথে বসতে হবে এমনকি মাছ চাষে আগ্রহ হারাবে অনেকেই বলে মনে করছেন জেলার সচেতন মহল। তারা আরও জানান, সুনামগঞ্জের হাওর, নদী, জলাশয়ে মাছ কমে যাচ্ছে। হারিয়ে গেছে কয়েক প্রজাতির মাছ। তিলা শোল, ঢেলার মতো পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ মাছ হাওরে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। বিপন্ন তালিকায় আছে অনেক জাতের মাছ। বিপন্ন মাছ ফিরে পেতে মৎস্য বিভাগের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন।

জেলা মৎস্য বিভাগ সুত্রে জানা যায়, দ্বিতীয় দফা বন্যার পানিতে সুনামগঞ্জের সরকারি-বেসরকারি ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুরের সব তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন ২০টি ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৫৩টি, বাকি গুলো ব্যক্তি মালিকানাধিন। ভেসে গেছে পুকুরগুলোর মাছ ও পোণা। এবার দু দফা বন্যার মধ্যে প্রথম দফায় ক্ষতির পরিমাণ কম হলেও দ্বিতীয় দফায় বন্যায় চরম ক্ষতির শিকার হয় ১৭হাজার মাছ চাষী। তারা এখন এই ক্ষতি কি ভাবে পোশাবে সে চিন্তায় দিশেহারা। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড় ঢলের পানিতে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় ভেষে গেছে ত্রিশ হাজার টন মাছ। ভেষে গেছে কয়েক কোটি মাছের পোনাসহ কয়েক শ কেজি মাছের রেনো। ২৫ হাজারের অধিক পুকুরের তিন হাজার হেক্টর পুকুরের পাড় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

খোজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৬ জুন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে পাহাড়ী ঢলের পানি বাড়তে থাকায় শনিবার সকালে প্রতিটি পুকুরে মাছ ভেষে যায়। পাহাড়ি ঢলের স্রোতের তোরে পুকুরের পাড় ভেঙে ও জাল দিয়ে আটকানোর কোনো সুযোগ আর সময় ও পায়নি মাছ চাষীরা। চোখের সামনেই তলিয়ে মাছ ভেসে যায় কিছুই করার ছিল না তাদের। মাছের খাবার বিক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

মাছের খাবার বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যায় শুধু মাছ চাষিরা নন তাঁদের সঙ্গে আমরাও বিপাকে পড়েছি। চাষিদের কাছে লাখ লাখ টাকা পাওনা। অনেকে ক্ষতির বিষয়টি জানাচ্ছেন। সরকার থেকে মাছ চাষিদের পাশে না দাঁড়ালে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর গ্রামে আল-আমিন ব্রাদার্স মৎস্য হাচারির মালিক আশরাফুর হক বলেন, আমার এখানে রেণু থেকে পোনা মাছ উৎপাদন করি। বন্যায় প্রায় ১৫-১৬ লাখ টাকার পোনা মাছ ভেসে গেছে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে হ্যাচারিটি করেছিলাম। এখন কীভাবে ব্যাংক ঋণ দেবো এই চিন্তায় আছি।

সদর উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের মডার্ন এগ্রোর স্বত্বাধিকারী মুসলিম উদ্দিন বলেন, বন্যায় প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। এত বড় ক্ষতি কি ভাবে পোষাব।

জেলার তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়ন মাছ চাষী ফজলুল হক জানান, তার পুকুরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ করেছেন। কিন্তু পর পর দু দফা বন্যায় সব মাছ পানির তোরে ভেসে গেছে। এই ক্ষতি কিভাবে পোষাব কি ভাবে কি করব মাথায় আসছে না।

উত্তর বড়দল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুক মিয়া জানান, বন্যার যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনো ভাবেই পোষানো সম্ভব নয়। সব শেষ করে দিয়েছে যা বলে প্রকাশ করা যাবে না। এই বন্যা পূর্বের সকল রেকর্ড অতিক্রম করে আমাদের এলাকার সকল মাছ চাষীদের সর্বশান্ত করেছে।

সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডল বলেছেন, এবার জেলায় দু দফায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ চাষীদের সরকারী ভাবে পূনর্বাসনের জন্য তালিকা তৈরি করে আমার উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ আসলেই তা বিতরন করা হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডন আরও জানান, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সরকারি ১৭৩ ও বেসরকারি ২৫ হাজার পুকুর বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। প্রায় ৩০ হাজার টন মাছ ও ১০ কোটি মাছের পোণা পানিতে ভেসে গেছে। পুকুরের অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

ডব্লিউজি/এএইচ

শেয়ার করুন:

Recommended For You

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *