শারীরিক গঠনে ১০ বছর বয়সী শিশু; কিন্তু অনার্সের শিক্ষার্থী!

মেয়েটির নাম তানিয়া। বয়স ২২ বছর। আটঘরিয়ার চাঁদভা ইউনিয়নের হাপানিয়া গ্রামের রিক্সাচালক তাজুল ইসলামের মেয়ে সে। দেখতে ১০ বছর বয়সী শিশুর মত হলেও সে এখন অনার্সের শিক্ষার্থী। জন্মের পর থেকে ঠিকঠাকই বেড়ে উঠছিলো তানিয়া। ৫ম শ্রেণীতে পড়ার সময় হঠাৎই তার শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে থাকে। ঘন ঘন পরিলক্ষিত হয় ঠান্ডা, জ্বর ও ক্ষুধামন্দা সহ নানাবিধ সমস্যা। এরপর থেকেই প্রবৃদ্ধি না ঘটে অনেকটা হ্রাস পেয়েছে তার শারীরিক গঠন। দেখতে রয়ে গেছে সেই ছোট্ট শিশুটি। কন্ঠেও তার শৈশবের ছাপ। এতে তাকে নিয়ে পাড়ার বন্ধু-বান্ধবীরা করতে থাকে নানা ধরণের কটুক্তি ও তামাশা। একই দৃশ্য পরিলক্ষিত হয় তানিয়ার অধ্যয়নরত বিদ্যালয়ে। সহপাঠীরাও তাকে করতে থাকে অবহেলা। এতো এতো সকল বাধা বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তানিয়া এখন আটঘরিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রজব আলী জানান, আর দশটা শিক্ষার্থীর মতই আমরা ওকে দেখছি। বরং লেখাপড়ার প্রতি দারুণ স্পৃহা সম্পন্ন ওর মত একজন শিক্ষার্থী পেয়ে আমরা গর্বিত বোধ করছি। কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মোঃ শরীফুল আলম এ বিষয়ে জানান, এই কলেজে লেখাপড়া বিষয়ক সমস্ত দায় আমরা নিয়েছি। সমস্ত শিক্ষার্থীদেরও বলে দিয়েছি যেনো ওকে কেউ ভিন্ন নজরে না দেখে। আমরা ওর পাশে আছি।

আটঘরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ তানভীর ইসলাম বলেন, সরকার অটিস্টিকদের প্রতি বিশেষ নজর রাখছেন। আমরাও তানিয়ার প্রতি বিশেষ নজর রাখবো। এতো বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে তানিয়ার আজকের অবস্থান অন্যান্য বিশেষ শিশুদের জন্য অনুপ্রেরণা। এক্ষেত্রে তানিয়া আমাদের আটঘরিয়া তথা পাবনার গর্ব। তানিয়ার সহপাঠী সামিয়া তাবাচ্ছুম বিথি বলেন, ভর্তি হবার পর খুব অল্প সময় তাকে দেখছি। খুবই শান্ত স্বভাবের একটি মেয়ে তানিয়া। আমরা তাকে কোনোভাবেই আলাদা চোখে দেখি না। আমরা সহপাঠী তথা বন্ধু হয়ে ওর পাশে আছি।

বাবা তাজুল ইসলাম জানান, ঠিকঠাকই বেড়ে উঠছিলো তানিয়া। ৫ম শ্রেণীতে পড়ার সময় মাঝে মাঝে দেখা দিতে থাকে ঠান্ডা-জ্বর ও ক্ষুধামন্দা সহ নানা ধরণের ছোট খাটো রোগ। এরপর দেখা যায় ঠিকঠাক তার শারীরিক বৃদ্ধি হচ্ছে না। তখন এলাকার লোকদের পরামর্শে চিকিৎসা করাতে যাই। কিন্তু রিক্সাচালক দিনমজুর হিসেবে আর্থিক দৈন্যতায় দুই মাস চিকিৎসা চালাতে পারলেও পরে আর সেটা পারিনি। তারপর থেকে তার শারীরিক গঠন আরো অবনতি হয়। এখন সবাই অটিজম বলে তামাশা করে। বিয়ে দিতে পারব না। বোঝা হয়ে দাঁড়াবে সে। কিন্তু আমি ওকে সেভাবে দেখিনি। আমি ওকে সব সময় লেখাপড়ায় অনুপ্রেরণা দিয়েছি। সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের কাছে আমার আবেদন উন্নত চিকিৎসা যদি ওকে করানো যেতো তাহলে অনেকটা স্বাভাবিক হতে পারতো। ভবিষ্যৎ একটা ব্যবস্থা যদি কেউ করে দেয় তাহলে সে আর বোঝা হয়ে থাকবে না।

পাবনা ডায়াবেটিস হাসপাতালের মেডিসিন, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ মোঃ শাহিনুর রহমান এবিষয়ে জানান, এগুলো হরমোন বিষয়ক সমস্যা। বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনজনিত নানা সমস্যার কারণেও শারীরিক গঠন অনেক সময় রোধ পায়। উন্নত চিকিৎসা দেয়া হলে এখনো অনেকটা ইমপ্রুভ হওয়া সম্ভব। তানিয়া জানান, আমার শারীরিক গঠন স্বাভাবিক না হওয়ায় পরীক্ষার সময় অনেকেই আমাকে পাশে বসতে দিতে চাইতো না। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। তবুও আমি ভেঙে পড়িনি। লেখাপড়া চালিয়ে গেছি। বোঝা নয় লেখাপড়া করে পরিবারের অবলম্বন হতে চাই।

উল্লেখ্য আটঘরিয়া উপজেলার চাঁদভা ইউনিয়নের হাপানিয়া গ্রামের তাজুল ইসলামের মেয়ে তানিয়া। বাবা রিক্সাচালক ও মা গৃহিণী। বেরুয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী শেষ করে বেরুয়ান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হন তিনি। এরপর ২০১৯ সালে জিপিএ ৩.৫৬ পেয়ে মানবিক বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বেরুয়ান মহিলা কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এরপর ২০২১ সালে একই বিভাগ থেকে জিপিএ ৩.৬৭ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সর্বশেষ আটঘরিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয়ে অনার্স ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন তিনি।

ডব্লিউজি/এমএ

শেয়ার করুন:

Recommended For You

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *