এক পা অচল ড্রাইভার রাজুর ছিলো না লাইসেন্সও

দশ বছর ধরে  এক পা দিয়েই তিনি চালাচ্ছিলেন মালবাহী ট্রাকের মতো ভারি বাহন। আবার সেই ট্রাকের কোনো কাগজপত্রের মেয়াদও ছিলো না।

ত্রিশালে সন্তান ও স্বামীসহ অন্তঃসত্ত্বা নারীর জীবন কেড়ে নেয়া ট্রাক চালক রাজু আহমেদ ওরফে সিপন চালক হবার মতো শারীরিক যোগ্যতা ছিলো না। তার এক পা ছিলো অচল। ড্রাইভার রাজুর ছিলো না ভারি বাহন চালানোর লাইসেন্সও।

গত ১৬ জুলাই দুপুরে ময়মনসিংহের ত্রিশালের রায়মনি গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম তার আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না বেগমকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন।

এ সময় মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় একটি ট্রাক বেপরোয়া গতিতে তাদের চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় স্বামী স্ত্রী ও ছয় বছরের মেয়ে।

ওই দুর্ঘটনায় মৃত মায়ের পেট ফেটে সড়কেই জন্ম হয় নবজাতকের।

এ সময় সড়কে পড়ে থাকা মৃত মায়ের পেট ফেটে জন্ম নেয় তার গর্ভের সন্তান। সেই মেয়েশিশু এখন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।

এই সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাতনামা চালককে আসামি করে মামলা করেন জাহাঙ্গীর আলমের বাবা। সোমবার রাতে সাভার থেকে চালক রাজু আহমেদ শিপনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে বাহিনীটি জানায়, ট্রাক চালক রাজু ১০ বছর আগে আরেক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হবার পর তার একটি পা অচল হয়ে যায়।

কিন্তু সেই অবস্থাতেই গেলো ১০ বছর ধরে তিনি মাল বোঝাই ভারি ট্রাক চালিয়ে আসছেন। দুর্ঘটনার দিনও তার সাত টনের ট্রাকে সাড়ে ১৩ টন মালামাল ছিলো।

আর সে কারণেই টাল সামলাতে না পেরে তিনি ট্রাক তুলে দেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে সড়ক পারাপারের অপেক্ষায় থাকা অন্তঃসত্ত্বা নারী, তাঁর স্বামী ও সন্তানের ওপর।

রাজুর ভারী যান চালানোর অনুমতি ছিল না। তাঁর মধ্যম সারির যান চালানোর একটি সনদ ছিল। এই সনদেরও মেয়াদ পেরিয়ে যায় ২০১৬ সালে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজু ১১ জুলাই থেকে টানা পাঁচ দিন ট্রাক চালাচ্ছিলেন। ত্রিশালে দুর্ঘটনার দিন তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আম ও রাজশাহীর নৌহাটা থেকে আলু-পেঁয়াজ নিয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে যাচ্ছিলেন।

তিনি বলেন, চালক রাজু আগে জেল খেটেছেন। ২০০২ সালে যশোরের এক ট্রাক চালকের সহকারী ছিলো। সে সময় এক দুর্ঘটনায় তাঁর বাঁ পা জখম হয়। এখনো তাঁর বাঁ পা অচল।

র‌্যাব জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে রাজু দাবি করেন, ত্রিশালে তার ট্রাকটির পেছনে যাত্রীবাহী একটি বাস ছিল। বাসটি অনবরত হর্ন বাজাচ্ছিল। তিনি বাসটিকে জায়গা দিতে বাঁয়ে চাপানোর চেষ্টা করেন। এ সময় ব্রেক কাজ করছিল না ফলে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারান।

সড়কের পাশে দাঁড়ানো পরিবারটিকে রাজু দেখতে পাননি বলে দাবি করেছেন। ট্রাকের মালিক রাজশাহীর ব্যবসায়ী মনজুর। দুর্ঘটনার সময় ট্রাকচালক রাজুর সহকারী খায়রুল ঘুমাচ্ছিলেন। ট্রাকের ফিটনেস সার্টিফিকেটও ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।

সড়কে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনার দায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন মালিকরাও এড়াতে পারে না। শারীরিকভাবে অক্ষম একজন চালককে দিয়ে ট্রাক চালানোর অভিযোগে মালিকের বিরুদ্ধেও তদন্ত হবে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাব আরও জানায়, দুর্ঘটনার পর উপস্থিত লোকজন ট্রাকটি থামায়। তখন সুযোগ বুঝে রাজু ঢাকাগামী একটি বাসে উঠে পড়েন। পরবর্তী সময়ে বাস থেকে তিনি ময়মনসিংহ বাইপাসে নামেন এবং সেখান থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে প্রথমে মুক্তাগাছা এবং পরে অপর একটি বাসে করে তিনি টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় পৌঁছান।

সেখান থেকে রাজু তার পরিচিত বিভিন্ন ট্রাকচালকের ট্রাকে উঠে আত্মগোপনে থাকেন। সোমবার এমন একটি ট্রাক সাভারে পৌঁছালে সেখান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলেই নিহত হন জাহাঙ্গীর আলম (৩৫) ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না বেগম (২৬)। এ ছাড়া তার তিন বছর বয়সী মেয়ে সানজিদা আক্তারকে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে মারা যায়।

 

 

শেয়ার করুন:

Recommended For You

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *