পদ্মা সেতুকে ঘিরে সম্ভাবনার নয়া দিগন্তের দারপ্রান্তে দক্ষিণাঞ্চল

কুয়াকাটা-ঢাকা রুটে এবারে ফেরি যুগের ইতি। উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ফেরিবিহীন যান চলাচলের নতুন যুগে প্রবেশ করবে এ অঞ্চলের মানুষ। স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার পর থেকে পুরো বাংলাদেশের মতো আনন্দের জোয়ার বইছে সাগরকন্যা পটুয়াখালীর প্রতিটি জনপদে।পায়রা সেতুর উদ্বোধনের আমেজ কাটতে না কাটতেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করেছে সেতু বিভাগ।

আর এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী এক নতুন জনপদের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন উপকূলের মানুষ। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়, দল-মত নির্বিশেষে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ঘোষণায় সরগরম হয়ে উঠেছে তৃণমূলের প্রতিটি জনপদ। সম্ভাবনার নতুন দিগন্তের দারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণাঞ্চল। পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন অধ্যায় যোগ হবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।

পটুয়াখালী সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকা-কুয়াকাটা রুটের প্রমত্তা পায়রা নদীর ওপর ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক পায়রা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পায়রা সেতু উদ্বোধনের পর কুয়াকাটা থেকে পটুয়াখালী-বরিশাল হয়ে ঢাকায় যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি মাত্র ফেরি ছিল পদ্মায়। আগামী ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী এ সেতু উদ্বোধন করলে কুয়াকাটা-ঢাকা রুটে ফেরি যুগের অবসান ঘটবে। ফেরিবিহীন যান চলাচলের নতুন যুগে প্রবেশ করবে এ অঞ্চলের মানুষ। আর নতুন এ যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে দেশের তৃতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপান্তর হবে গোটা দক্ষিণাঞ্চল, এমনটা মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।

সম্ভাবনার নতুন দিগন্তে পর্যটন শিল্প: পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে সম্ভাবনার নতুন দিগন্তে প্রবেশ করবে সগরকন্যা কুয়াকাটার পর্যটন শিল্প। ঢাকা থেকে সড়কপথে এত কম দূরত্বে আর কোনো আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট না থাকায় সাগরকন্যার বুকে এখন যে পরিমাণ দেশীয় পর্যটকের আগমন ঘটে ২৫ জুনের পর তা প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মাত্র চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে মানুষ কুয়াকাটায় পৌঁছে যাবে। বুড়িগঙ্গা সেতু পার হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত পৌঁছতে থাকছে না কোনো যানজটের সম্ভাবনা। পর্যটকের আগমন দ্বিগুন হলেও এখনো সে তুলনায় আবাসন কুয়াকাটায় প্রস্তুত নয়।

তবে সময়ের প্রয়োজনে কুয়াকাটায় আরও বড় বড় বিনিয়োগ আসবে এবং প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে আশাবাদী কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ। তিনি বলেন, যদি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা যায়, তা হলে কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবন, সোনার চর, চর বিজয়, কুকরি-মুকরির মতো দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলোতেও পর্যটকরা ভ্রমণ করবেন। তিনি আরও জানান, মসৃণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে সরকার একটি গুচ্ছ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। সেটি বাস্তবায়ন হলে শুধু কুয়াকাটায় অর্ধলক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং পর্যটননির্ভর অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে।

পায়রা বন্দর-ইপিজেডে স্বপ্নের হাতছানি: বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৩ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পায়রা পোর্ট কর্তৃপক্ষ গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই মাসেরই ১৯ নভেম্বর পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার রামনাবাদ নদীর তীরে প্রায় সাত হাজার একর জায়গাজুড়ে পায়রা সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট পদ্মা সেতুর পাথর নিয়ে এমভি ফরচুন বার্ড নামের জাহাজ প্রথম পায়রা বন্দরে বাণিজ্যিক জাহাজ হিসেবে নোঙর করে। পদ্মা সেতু নির্মাণযজ্ঞের অধিকাংশ মালামাল, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন মালামাল খালাস করে পায়রা এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক বন্দরে রূপ নিচ্ছে বলে দাবি বন্দর কর্তৃপক্ষের। বন্দর সূত্র জানায়, শুধু ২০১৮ সালে এ বন্দর থেকে ৩ লাখ ১৫ হাজার ২১২ টন পাথর আনলোড করা হয়েছে। ২০১৯ সালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লাসহ ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯২ টন পণ্য, ২০২০ সালে এক দশমিক চার মিলিয়ন টন এবং ২০২১ সালে এক দশমিক পাঁচ মিলিয়ন টন পণ্য খালাস করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। পায়রা বন্দরের ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং ২০৩০ সালে পুরোপুরি বন্দর চালু হলে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এই বন্দরে।

পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দীন জানান, পায়রা বন্দরের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এতদিন বাধা ছিল পদ্মা নদীর সেতু। সেতুটি যান চলাচলের উন্মুক্ত হলে এ অঞ্চলের মানুষকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে সরকার পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুরের পঁচাকোড়ালিয়া মৌজায় ৪১০ একর জমিতে ইপিজেড নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। নির্মাণাধীন ইপিজেডের কারণে এ অঞ্চলে নতুন নতুন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করেছে। জমির দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে। প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইপিজেড চালু হলে শুধু সেখানেই দেড় লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে দাবি করেন তিনি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মহিউদ্দীন আহমেদ জানান, এ বছর জেলায় ৮৬ হাজার ৪৩১ হেক্টরে উচ্চফলনশীল ও স্থানীয় জাতের মুগের আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ২৫০ টন। কেজিপ্রতি ৬০ টাকা দরে বিক্রি করা হলেও এবার পটুয়াখালীর চাষিরা এক হাজার কোটি টাকার মুগ ডাল বিক্রি করবে। পদ্মা সেতু চালু হলে মসৃণ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এ ডালের দাম কৃষক পর্যায়ে দেড়গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা। তিনি আরও জানান, পটুয়াখালী থেকে সারা দেশে তরমুজ সরবরাহ করা হয়। শত শত কোটি টাকার তরমুজ আগে নষ্ট হতো পরিবহনের কারণে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিঘাটে পণ্য নিয়ে বসে থাকার ফলে তা পচে যেত। এখন কিন্তু সেটার সম্ভাবনা নেই। চাষিরা এখন অনেক ভালো দাম পাবেন কৃষিপণ্যের, উপকূলের সবচেয়ে বড় মৎস্যবন্দর আলীপুর-মহিপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দিদার উদ্দীন তালুকদার মাসুম ব্যাপারী জানান, প্রতিবছর কয়েকশ কোটি টাকার মাছ মাওয়া ঘাটে পচে যেত। টনকে টন মাছ ফেলে দিতে হয়েছে। মহাজনদের লাখ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু চালু হলে হাজার হাজার কোটি টাকার ইলিশ নিয়ে তাদের আর ভাবতে হবে না। কুয়াকাটা থেকে ঢাকা পর্যন্ত চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টায় সমুদ্রের তাজা ইলিশ তারা সরবরাহ করতে পারবেন।

পটুয়াখালীর সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য কাজী কানিজ সুলতানা হেলেন বলেন, ২০৪১ সালের যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূল থেকে শুরু করেছেন। আগামী প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করবে বলে দাবি করেন তিনি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন জানান, আগামীতে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক করিডর হবে পটুয়াখালী জেলা। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম অঞ্চলে রূপান্তরিত হবে এটি। পায়রা বন্দর, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা, আউলিয়াপুর ইপিজেড, শেখ হাসিনা সেনানিবাস, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজসহ একটি অঞ্চলে যা যা প্রয়োজন, সবই পটুয়াখালীতে দৃশ্যমান। কুয়াকাটা থেকে ঢাকা ফেরিবিহীন মসৃণ যোগাযোগ। শুধু পটুয়াখালীতেই আগামী দু-এক বছরের মধ্যে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। পায়রা নদীতে দ্বিতীয় সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। লোহালিয়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কাজ সমাপ্তের পথে। বগা এবং গলাচিপায় সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ ছাড়া নদীপথ ড্রেজিং করে চলাচল স্বাভাবিক রাখা হচ্ছে। আগামী দিনে নতুন স্বপ্নের জাল বুনবে পটুয়াখালীর মানুষ- সেটাই স্বাভাবিক।

ডব্লিউজি/এএইচ

শেয়ার করুন:

Recommended For You

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *