সীমান্তে সংগঠিত সকল হত্যার বিচার হোক

সীমান্তে সংগঠিত সকল হত্যার বিচার হোক

ভারতের সঙ্গে মোট ৬টি দেশের সীমান্ত। ৫টি দেশের সীমান্তে শান্তিপূর্ণ, সহমর্মিতা ও সহযোগিতাপূর্ণ থাকলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করে থাকে। ভারত যেন সীমান্ত এলাকাকে একটি দক্ষিণ এশিয়ার হত্যার ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। নানা অজুহাতে বাংলাদেশের সীমান্ত গ্রামগুলোর নিরস্ত্র এবং অসহায় স্থানীয় বাসিন্দাদের হত্যা করছে গরু চুরির তকমা দিয়ে।

পহেলা সেপ্টেম্বর রোববার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে স্বর্ণা দাস নামে ১৪বছর বয়সী অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। সেদিন রাতে মা সঞ্জিতা রানী দাসের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরায় থাকা ভাইকে দেখতে যাওয়ার সময় এই ঘটনা ঘটে। তারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ইরানি থানার কালেরকান্দি সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে পৌঁছালে বিএসএফ তাঁদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। গুলিতে কিশোরী স্বর্ণা মারা যায় এবং স্বর্ণার মা সহ কয়েকজন আহত হয়।স্বর্ণার মরদেহ বিএসএফ নিয়ে যায়।স্বর্ণা দাসের মরদেহ ৪৫ ঘণ্টা পর ফেরত দিয়েছে ভারতীয় পুলিশ।গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় দুই দেশের পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে স্থানীয় চাতলাপুর চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে ওই কিশোরীর মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।

সীমান্তে স্বর্ণা হত্যার ১৩বছর আগে ২০১১ সালে আলোচিত আরেক হত্যা হয়েছিল কুড়িগ্রামের ফেলানীর। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের নুরুল ইসলাম পরিবার নিয়ে থাকতেন ভারতে দিল্লিতে৷ মেয়ে ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল বাংলাদেশে৷ বিয়ে দিতে ২০১১ সালের ৬ জানুয়ারি মেয়েকে সঙ্গে করে আসেন অনন্তপুর সীমান্তে৷ ৭ জানুয়ারি ভোরে দালালের মাধ্যমে ফুলবাড়ী অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে কাঁটাতারের ওপর মই বেয়ে নামার সময় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় ফেলানীর৷ দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকে ফেলানীর মরদেহ৷

কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশের ছবি আলোড়ন তুলেছিল দেশে-বিদেশে৷ ফেলানীর ঝুলে থাকার ছবি প্রচার হওয়ার পর গণমাধ্যমসহ মানবাধিকারকর্মীদের সমালোচনায় ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারের বিএসএফ’র বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়৷ ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত৷ বিজিবির আপত্তিতে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার শুরু হলেও সেখানে খালাস দেওয়া হয় অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে৷ এরপর ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ভারতীয় মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) মাধ্যমে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন৷ পিটিশনের ভিত্তিতে কয়েক দফায় শুনানির দিন পিছিয়ে এখনও আদালতে ঝুলে আছে পিটিশনটি কাঁটাতারে ঝুলে থাকার মতো করেই।

একটা পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিগত দশকে বর্ডারে সবচেয়ে বেশি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের বর্ডারে।দ্বিতীয় ছিলো বাংলাদেশ ও ভারত বর্ডার অথচ আমারা ছিলাম সবচেয়ে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র!

সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ পেতে ভিজিট করুন https://worldglobal24.com/latest/

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ প্রায় নিয়মিতই সীমান্তে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশীদের হত্যা করছে৷ দুই বৈরী প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গোলাগুলি কিংবা হত্যাকাণ্ড বিরল নয়৷ কিন্তু পরস্পরকে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধু দাবি করে আসা দুই দেশের সীমান্তে একটি দেশ কর্তৃক নিয়মিতভাবে অন্য দেশের নাগরিককে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ বেসরকারী মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুয়ায়ী, ২০২৩ সালে ৩১ জন বাংলাদেশি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন৷ ২০২১ ও ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৮ ও ২৩৷ আসকের হিসাবে এর আগে ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১১ বছরে ৫২২ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে মারা গেছেন৷ এ বছরও ১৫ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে৷

সীমান্তে বাংলাদেশিদের যেভাবে হত্যা করা হয়, চীন, পাকিস্তান কিংবা নেপাল সীমান্তে কিন্তু এত হত্যা নেই। সেখানে এতো আগ্রাসী থাকে না বিএসএফ। বাংলাদেশের সাথে থাকা সীমান্তে বিএসএফ যতটা গরম, অন্যদেশের সাথে থাকা সীমান্তগুলোতে ততটাই নরম। কিন্তু এর পেছনে কারণ কী?এর প্রধান কারণ ছিল হাসিনা সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি। সীমান্তে অব্যাহত এই নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাবেক সরকার প্রধান ও তাদের এমপি মন্ত্রীরা প্রতিবাদ তো দূরের কথা টু শব্দ পর্যন্ত করার সাহস দেখাতে পারেনি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ভারতকে একের পর এক তাদের চাহিদা মতো সুবিধা দিয়েছে বছরের পর বছর আর ভারত বছরের পর বছর বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করছে পাখির মতো।একমাস আগে ছাত্র জনতার গনঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।দেশে গঠন হয় অন্তর্বঅন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

কিছুদিন আগে গত ১৩ আগস্ট বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দফায় দায়িত্ব পাওয়া স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন পিলখানায় গিয়ে বলেছিলেন, বিজিবির মতো ফোর্সকে সীমান্তে পিঠ দেখাতে বলা হয়েছিল৷ সীমান্তে বাংলাদেশের লোক মারে, আর বিজিবিকে ফ্ল্যাগ মিটিং করতে বাধ্য করা হয়৷ সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, “আমি বিজিবিকে বলেছি, পিঠ দেখাবেন না৷ এনাফ ইজ এনাফ, আর নয়।” সীমান্ত হত্যা নিয়ে এটি ছিল ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারি সবচেয়ে জোড়ালো বক্তব্য।

৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠানো নোটে এ প্রতিবাদ জানানো হয় স্বর্ণা হত্যার। প্রতিবাদ নোটে বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের নির্মম কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের অন্তর্বর্তী সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূস ঢাকায় তার সরকারি বাসভবনে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সীমান্ত হত্যার নিন্দা জানিয়ে বলেন, হত্যা কোনো সমাধান নয়। তিনি বলেন, ‘কাউকে হত্যা করা কোনো সমাধান নয়, কারণ এটি মোকাবিলা করার আইনি উপায় রয়েছে। এটি পরিচালনা করার জন্য একটি স্থল প্রক্রিয়া এবং আইনি পদ্ধতি থাকতে হবে। এটা একতরফা ব্যাপার। দেশ দখলের জন্য কেউ সীমান্ত অতিক্রম করছে না। যারা গুলি করে হত্যা করছে তারা শুধুই নির্লজ্জ। এটা উদাসীনতা। এটা বন্ধ করতে হবে।’সাক্ষাৎকারটি প্রচার হয় ৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার।

সীমান্তে প্রতিনিয়ত হত্যা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কোনোক্রমেই মানা যায় না। সীমান্তে দেখলেই কাউকে গুলি করতে হবে এমন আইন পৃথিবীর কোথাও নেই। কাউকে মেরে ফেলার অধিকার কারো নেই। সীমান্তে সংগঠিত প্রতিটি হত্যার প্রতিবাদ জানাই।দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুরোধ করছি সীমান্ত হত্যার সাথে জরিত বিএসএফ সদস্যদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত সীমান্তে যত হত্যা হয়েছে সে সবকটি হত্যার দ্রুত বিচার করা হোক।

 

 

লেখক: সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী।

শেয়ার করুন:

Recommended For You