লক্ষ্মীপুরে শনিবার থেকে সোমবার বিকাল পর্যন্ত ৩ দিনের টানা বৃষ্টিতে পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। লক্ষীপুরের পাঁচটি উপজেলা ও পৌরসভার প্রায় সকল সড়ক ডুবে গিয়েছে। সদর পৌরসভার জেবি রোড, বাঞ্ছানগর, সমসেরাবাদ, কলেজ রোড ও মিয়া আবু তাহের সড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটুপানি জমে থাকায় দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে পৌরবাসী। গত শনিবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত জেলায় বৃষ্টি অব্যাহত থাকে।
টানা ভারী বর্ষণে লক্ষ্মীপুরের বিভিন্নস্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের বহু রাস্তাঘাট, বাড়ি ঘর এখন পানির নিচে রয়েছে। ভেসে গেছে শতাধিক ঘের ও পুকুরের মাছ। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৎস্য চাষীরা। আমনের বীজতলাও নষ্ট হয়েছে বলে জানান কৃষকরা।
স্থানীয়রা বলছেন পর্যাপ্ত ড্রেনেজ এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা এবং সংশ্লিষ্টরা উদাসীন হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।
জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেঘনাতীরবর্তী এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি খুব সহজে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এতে নদীভাঙনসহ উপকূলীয় বাসিন্দাদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
কমলনগর উপজেলার কালকিনি,সাহেবেরহাট, পাটওয়ারীরহাট, চরফলকন, চরমার্টিন, চরলরেন্স ইউনিয়ন এবং রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার, বড়খেরী, চরগাজী, চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের ২০টি এলাকার জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে প্লাবিত হয়। এতে নতুন করে মেঘনার ভয়াবহ ভাঙন দেখা গেছে।
রায়পুর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভার সর্বত্র নজিরবিহীন এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। চরবংশী, চরআবাবিল, চরমোহনা, সোনাপুর, কেরোয়া, বামনী, চরপাতা উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশী ও পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের বহু গ্রামের সাথে অন্যান্য গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কৃষকের জমিসহ গ্রামের বাড়ি ঘর ছাড়াও স্কুল, কলেজে পানি ঢুকে পানি বন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। অপরিকল্পিতভাবে ঘর-বাড়ি নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের পথ না রাখাসহ বিভিন্ন কারণে এ বছর রায়পুরে নজিরবিহীন এ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে।
সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ পেতে ভিজিট করুন https://worldglobal24.com/latest/
রামগতিতে ভুলুয়া নদীর দুই পাড় ভরাট হয়ে খালে পরিনত হওয়ায় স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। আর এই জলাবদ্ধতায় আটকা পড়েছে কয়েক শত বসত বাড়ি ও হাজার একর আমনের জমি।
সরেজমিনে দেখা যায়, রামগতি উপজেলার পোড়াগাছার স্লুইসের বেড়ির মাহফুজ মিয়া ঢাল থেকে আজাদনগর বাজারে দক্ষিণ-পূর্বে নদীর দুইপাশে ঝুপড়ির মত ছোট-বড় বসত ঘর, দোকান ও গাছপালা রয়েছে। ৪০০ মিটার চওড়া নদীটি দখলের কারণে ১০০-১৫০ মিটারে রূপ নিয়েছে। এতে চর বাদাম, পোড়াগাছা, চর কাদিরা, তোরাবগন্জ, চর জাঙ্গালিয়ার প্রায় দুই হাজার বাড়িঘর অতিবৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। সে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
আজাদনগর, চার রাস্তা, পাটোয়ারী বাজার, চর বসু, তোরাবগনজ, চর বাদাম এসব প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের বাড়িঘর পানিতে থৈ থৈ করছে। চোখ যতদূর চোখ যাচ্ছে- দেখা যাচ্ছে পানি আর পানি। মানুষকে নৌকা বা ডিঙিতে চলাচল করতে হচ্ছে। কৃষি জমির ফসল কোথাও চোখে পড়েনি। কিছু ফসল থাকলেও তা পানির নিচে রয়েছে। কোথাও আমনের বীজতলা দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা বা সড়কে মানুষ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ভেড়া ও মহিষ বেঁধে ঘাস ও গাছের লতাপাতা খাওয়াচ্ছে। জীবন যুদ্ধে গবাদি পশু বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। এছাড়াও নদীতে মাছ ধরার বিভিন্ন জালের কারণেও পানির স্রোত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
দেখা যায়, পানিতে সয়লাব থাকায় মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা যাচ্ছে না। পানিবেষ্টিত গ্রামগুলোকে একেকটি দ্বীপ বলে মনে হচ্ছে। ভেলা দিয়ে খড় এনে গবাদি পশুদের খাওয়ানো হচ্ছে। দেখা যায়, অনেক বাড়িতে রান্না করার চুলা পর্যন্ত নেই। শুকনো খাবার খেয়ে তারা দিন পার করছে। স্কুলগুলোও পানিতে প্লাবিত।
চর কাদিরা ইউপির সাবেক মেম্বার আব্দুল কাদের পাটোয়ারী জানান, চর কাদিরা, তোরাবগন্জ, চর বাদাম, আন্ডারচরসহ বেশ কিছু এলাকায় টানা বৃষ্টিতে পানি কোমড় সমান। বাড়ি-ঘর ডুবে গেছে, কৃষি জমি পানির নিচে।
কৃষক মো.কামাল জানান, ভুলুয়া নদীর দু’পাশ অবৈধ ঘর-বাড়িতে দখল হওয়ায় নদীর মুখ সরু হচ্ছে। মানুষ বাড়ি-ঘর, গবাদি পশু ও আমনের বীজতলা, সবজি বাগান নিয়ে জীবন জীবিকায় ঝুঁকিতে বসবাস করছে।
মো. মাইন উদ্দিন জানান, টানা বৃষ্টির কারণে চর কাদিরা, চর বাদাম ইউনিয়ন পানির নিচে ডুবে গেছে। বাড়ি-ঘরে থাকা যায় না। পানি নামতেছে না। প্রতিদিন পানি বাড়ছে। দ্রুত নদীর দুইপাশ দখলমুক্ত করা না গেলে উত্তর অঞ্চল ডুবে যাবে।
গতকাল সোমবার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে ১৩৮ মিলিমিটার এরও বেশি । টানা বৃষ্টির কারণে নিম্ম আয়ের মানুষ পড়েছেন চরম বিপাকে। এ ছাড়া বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন জেলা কৃষি বিভাগ। পাশাপাশি মেঘনার পানি বৃদ্ধি ও অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল হয়ে পানি লোকালয়ে ঢুকতে শুরু করেছে।
সরজমিনে গিয়ে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে চরম দুর্ভোগে পৌরবাসী। সামান্য বৃষ্টি হলে বাসাবাড়ি ও সড়কে হাঁটুপানি জমে যায়। সঠিকভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা না করা এবং খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয়রা। দ্রুত এসব সমস্যা সমাধানের দাবি করেন নাগরিকেরা।
পৌরসভার বাঞ্ছানগর এলাকার বাসিন্দা মিলন হোসেন ও বেলাল হোসেন বলেন, গত দুই দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে বাসাবাড়িতে হাঁটুপানি জমেছে। রান্নাবান্নাসহ সব কাজ বন্ধ। তবে ড্রেন দিয়ে পানি না যাওয়ায় এই সমস্যা হচ্ছে। অনেক দুর্ভোগে আছি। কয়েক দিন আগেও ১০ দিন পানিবন্দী ছিলাম। কেউ কোনো খবর রাখে না।
পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন জলাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘যেসব জায়গায় পানি জমেছে বা ড্রেন দিয়ে পানি নামতে সমস্যা হচ্ছে। ওই সব স্থানে ড্রেন পরিষ্কার করে দ্রুত সময়ে পানি সরানোর কাজ চলছে।’
আরও কয়েক দিন মেঘনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাহিদ-উজ-জামান। পাশাপাশি রামগতি আবহাওয়া সতর্কীকরণ কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো. সৌরভ হোসেন বলেন, ‘টানা বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো হালকা, কখনো মাঝারি আবার কখনো মুষলধারে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। রোববার বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে ১৩৮ মিলিমিটার।’
এদিকে লক্ষ্মীপুরে গত ১৫ দিনের প্রবল বর্ষণে আমনের বীজতলা পানিতে তলিয়ে কৃষকরা বড় ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে জেলার অধিকাংশ বীজতলা জলাবদ্ধ হয়ে পচে গেছে, যা চলতি মৌসুমে আমন ধানের আবাদ নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। জেলার কৃষকরা তাদের জমিতে পানি জমে যাওয়ায় আগাম আবাদ করা রোপা আমন ও আউশের খেতেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিবৃষ্টির কারণে লক্ষ্মীপুরে ৩১ হাজার ৯৫ কৃষক পরিবারের আমনের বীজতলা পানিতে পচে গিয়ে ১৭ কোটি ৬৬ লাখ ৯০ হাজার ৩৩৫ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। চলতি বছর জেলার ৫টি উপজেলায় ৫ হাজার ১২১ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা প্রস্তুত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৪১ হেক্টর জমি বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩২০ দশমিক ৫১ হেক্টর বীজতলা সম্পূর্ণরূপে পানির নিচে পচে গেছে, যা মোট ২৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ ক্ষতির পরিমাণ।
এ ছাড়া, রোপা আমন আবাদ করা ৭৫০ হেক্টর জমির মধ্যে ৮ দশমিক ৪৪ হেক্টর জমির ফসল বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আউশের খেতের মধ্যে ১৮ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমির ৫৭২ দশমিক ৭ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৯৫০ কৃষক পরিবারের রোপা আমন খেত ১২ হাজার ২২২ টাকা ও ৯ হাজার ২৪১ কৃষক পরিবারের আউশ খেত ৬২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩২ টাকা ক্ষতির শিকার হয়েছে।
কৃষকরা জানান, আগস্টের ১২ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, ফলে পুকুর, খালবিল ও নালা বৃষ্টির পানিতে ভরাট হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি না নামায় বীজতলায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে অধিকাংশ চারাগাছ পচে গেছে। নতুন করে বীজতলা তৈরির সময় না থাকায় আমনের আবাদ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
চাষিরা জানান, আষাঢ় মাসের শুরুতে আমনের বীজতলা তৈরি করেন ও শ্রাবণ মাসের শুরুতে চারা রোপণ করেন। জুলাইয়ের শেষ থেকে চলতি মাসের ১৫ দিনের ভারী বৃষ্টির কারণে বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে বীজতলার হাঁটু পানিতে ডুবে চারাগাছের পাতা কালো হয়ে পচে যাচ্ছে। এতে একজন কৃষক বীজতলায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
স্থানীয় কৃষক মো. সেলিম পাটোয়ারী বলেন, ‘দহশালা চর রুহিতা ও মৌজা নদী গ্রামের দুই শতাধিক কৃষক প্রতি বছর আড়াই শ একর জমিতে ধান চাষ করেন। কিন্তু ওই বৃষ্টির কারণে তাদের বীজতলা এখন পানির নিচে। এ বছর প্রায় ৪ হাজার ১৬৬ কেজি বীজ পচে গেছে। কৃষকরা ধারদেনা করে চাষাবাদ করেন। কিন্তু বৃষ্টির কারণে তাদের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে।’
কৃষক মফিজুর রহমান বলেন, ‘আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহে ৮০ কেজি বীজ দিয়ে আমনের বীজতলা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু এখন সব পচে গেছে। নতুন করে বীজতলা তৈরির সুযোগ নেই, তাই আমন আবাদ নিয়ে চিন্তিত।’
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শামছুদ্দীন ফিরোজ জানান, ‘বর্তমানে লক্ষ্মীপুরে ৫টি উপজেলায় ৮৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৯৮ টন। টানা বৃষ্টির কারণে আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এতে আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় বড় প্রভাব পড়বে না। চলতি মৌসুমে আমনের চাহিদার তুলনায় ১১৫ শতাংশ বেশি বীজতলা করা হয়েছে, ফলে ক্ষতি ১৫ শতাংশের বেশি হবে না। কৃষকরা যেন দুশ্চিন্তা না করেন এজন্য ফেনী কৃষি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা উন্নত জাতের বীজ পাঠালে কৃষকরা সংগ্রহ করতে পারবেন।’
জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান জানান, ‘টানা বৃষ্টির কারণে কৃষি খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির প্রতিবেদন এখনো হাতে আসেনি, পাওয়া গেলে সহযোগিতার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’