বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যম নাটক, চলচ্চিত্র ও ওয়েব সিরিজে তারকা বা অভিনয়শিল্পীদের মাধ্যমে সিগারেট, তামাক সেবনের দৃশ্য দেখানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে এসব দৃশ্য দেখানো বন্ধ এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনাপত্র দেওয়ার দাবি জানিয়েছে মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)।
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী এ দাবি জানান।
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৪ উপলক্ষ্যে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে মানস। সংবাদ সম্মেলনে তামাকের ভয়াবহতা নিয়ে বিভিন্ন জরিপ তুলে ধরেন অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী।
তিনি বলেন, দেশে তামাক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ তরুণ। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-২০১৭ এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছর থেকে তদুর্ধদের মাঝে তামাক ব্যবহারের হার ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা মোট জনসংখ্যার ৩ কোটি ৭৮ লাখ।
২০১৪ সালে পরিচালিত গ্লোবাল স্কুল-বেজড হেলথ সার্ভে (জিএসএইচএস) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বর্তমানে অনুকরণ, ফ্যাশন, স্মার্টনেস, কৌতুহল, পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি কারণে তরুণরা ধূমপান ও মাদকে আসক্ত হচ্ছে। যা তামাক ও মাদক ব্যবহারকারীদের আচরণ পর্যালোচনা করে পাওয়া গেছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যমে বিশেষ করে: নাটক, চলচ্চিত্র, ওয়েবসিরিজে জনপ্রিয় তারকাদের মাধ্যমে সিগারেট, মাদক সেবনের দৃশ্য দেখানো হয়। বর্তমানে প্রচলিত ক্যাবল নেটওয়ার্কের পাশাপাশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ওয়েব সিরিজ ও নাটক তরুণদের কাছে অনেক জনপ্রিয়। গ্লোবাল ডাটা রিসার্চ ফার্মের তথ্যনুযায়ী বাংলাদেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দর্শক সংখ্যা ৭০ লাখ। কিন্তু এসব প্ল্যাটফর্মের ওয়েব সিরিজ ও নাটকে সিগারেট ও এলকোহলের দৃশ্য অনেক বেশি দেখানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধূমপান ও মদ্যপানের দৃশ্য দেখানোর সময় আইনি সচিত্র সতর্ক বার্তা প্রচার করা হয় না।
তিনি আরও বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২০২০ সালে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৭৫ লক্ষ মাদকাসক্তদের মাঝে ৮০ শতাংশ তরুণ। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মাদকের মতো অ্যালকোহলের ব্যবহারকারী তরুণদের সংখ্যাও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মাঝে ৮৬ শতাংশ অ্যালকোহল ব্যবহারকারী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২০২০ এর বার্ষিক ড্রাগ রিপোর্ট অনুসারে, দেশে ১৫ বছর বয়সীদের ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ অ্যালকোহল ব্যবহারকারী এবং ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মাঝে ১৭ দশমিক ২৬ শতাংশ অ্যালকোহল ব্যবহারকারী। প্রায়শই জনপ্রিয় তারকা ব্যক্তিদের অনুকরণ করতে গিয়ে সিগারেট ও অ্যালকোহলের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তরুণরা।
তিনি আরও বলেন, কাহিনীর প্রয়োজনে বললেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধূমপানের দৃশ্য দেখানোর সময় আইন ও বিধি অনুযায়ী সচিত্র সতর্কবার্তা প্রচার করা হয় না। বরং বর্তমানে ট্রেন্ড হয়েছে টিভি চ্যানেল ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নাটক, সিনেমা, ওয়েবসিরিজের প্রধান চরিত্রের নায়ক বা নায়িকা কে দিয়ে ধূমপানের দৃশ্য প্রচার করা। এটা মূলত, তামাক কোম্পানির তামাকজাত দ্রব্যের এক ধরনের কৌশলী বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা। এর ফলে কিশোর-তরুণরা তারকাদের অনুকরণ করতে গিয়ে সিগারেটসহ বিভিন্ন আসক্তিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। তামাক কোম্পানির এই ধরনের প্রচারণা ও প্ররোচণার জন্য নিয়মিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, স্ট্রিমিং সার্ভিস ইত্যাদিতে তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন এবং তরুণদের প্রভাবিত করতে অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করা হচ্ছে মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া আইকন, সেলিব্রেটি, প্রভাবশালীদের।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে অভিনেত্রী রুমানা রশীদ ঈশিতা বলেন, তামাক ব্যবহার এবং ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। যারা বর্তমানে ধূমপান করছেন তারা অন্তত আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে ধূমপান ছেড়ে দিন।
ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজর অ্যাড. সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, আজকাল নাটক সিনেমায় তামাক ব্যবহার এবং ধূমপান করা প্রমোট করা হচ্ছে। বর্তমানে ধানমন্ডির বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সিগারেট খাওয়ার জন্য আলাদা জোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা চাই, সরকারের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, মানসের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান তালুকদার প্রমুখ।