আ জ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জিয়াউর রহমানের ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক দল সেনাসদস্যের গুলিতে প্রাণ হারান এই ক্ষণজন্মা পুরুষ।
শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী নেতা, সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। জাতির ক্রান্তিকালে তিনি ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন; সঠিক পথ নির্দেশ করেছেন। ৪৩তম শাহাদাতবার্ষিকীতে আমি এই দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন পদস্থ কর্মকর্তা হয়েও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই সাহসী ঘোষণা শুনে সেদিন দেশের ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি দীর্ঘ ৯ মাস বিভিন্ন রণাঙ্গনে বীরের মতো লড়ে গেছেন বিজয়ের মুহূর্ত পর্যন্ত। একইভাবে ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর যখন জাতি আবারও দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে, তখনও তিনি আবির্ভূত হন পথপ্রদর্শক হয়ে। তিনিই জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন; তলাবিহীন ঝুড়িকে সমৃদ্ধ করেছেন।
শহীদ জিয়াউর রহমান সম্পর্কে প্রতিপক্ষরা যা-ই সমালোচনা অথবা আলোচনা করুক না কেন, তিনি তাঁর সময়ের অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এক মানুষ ছিলেন। তিনি সময়কে ধারণ করেছিলেন এবং সময়কে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সময় তাঁকে ইতিহাসের মহানায়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেটা আমরা মানি অথবা না মানি, তাতে ইতিহাসের কিছু যায় আসে না।
ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন
যুদ্ধ শেষে সেনা ব্যারাকে ফিরে গিয়ে জিয়াউর রহমান পেশাদারিত্ব প্রমাণ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসে ভয়ংকরতম ঘটনায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। শুধু তাঁর দুই কন্যা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। ওই সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী পূর্ববর্তী সরকারের মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এ সময় উপসেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে খন্দকার মোশতাক সরকারের পতন ঘটে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়। পাঁচ দিনের মাথায় আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। যাকে দেশবাসী সিপাই-জনতার অভ্যুত্থান হিসেবে গ্রহণ করে। এই অভ্যুত্থানের পর শহীদ জিয়া জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। দেশবাসীকে তিনি শান্ত থাকতে বলেন এবং বাংলাদেশকে রক্ষার আহ্বান জানান। পরে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রপতি তাঁকে নিয়োগ দেন।
ইতোমধ্যে খন্দকার মোশতাকের পরিবর্তে সাবেক প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক সময় রাষ্ট্রপতি শারীরিক কারণে দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। এই পরিবর্তন ছিল ঐতিহাসিক। কারণ একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে পুনর্বার বহুদলীয় শাসনব্যবস্থায় দেশ ফিরে আসে।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর বিনা ভোটে ক্ষমতায় না থেকে দেশে ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোটের আয়োজন করেন। সেখানে তাঁকে জনগণ বিপুল ভোটে সমর্থন জানান। জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেন। সেখানে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ জেনারেল এমএজি ওসমানীকে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী করে। জিয়াউর রহমান প্রার্থী হন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের। এই নির্বাচনে জিয়াউর রহমান বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ও জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন। তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, একটি সদ্য স্বাধীন দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে যেমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা। তাই তিনি ১৯ দফা-সংবলিত রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপন করেছিলেন। সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে রাজনীতিতে মেধাবী ও পেশাজীবী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীদের অবহেলিত রেখে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তাঁদের কর্মক্ষম করে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশিদের সুস্পষ্ট একটা পরিচয় দেন– বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। দুর্নীতি, অনাচার বন্ধ করেছিলেন। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় নিয়ে গেছেন। খাল খনন করে কৃষিকাজে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। বিএডিসি গঠনের মাধ্যমে কৃষকের কাছে সার, বীজ, কীটনাশক সুষ্ঠু বিতরণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। বন্ধ শিল্প চালুর পাশাপাশি নতুন শিল্প গড়ে তোলেন। বেকার জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিকে রূপান্তর করা হয়।
জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই দেশে পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। গ্রামে শিল্পের মাধ্যমে উন্নয়নে তিনিই পল্লী বিদ্যুতায়নের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন। বাপেক্স গঠন করেছেন। জিয়া কৃষক ও শ্রমিকের উন্নয়নে উৎপাদনের রাজনীতি করেছেন; যুব ও নারীশক্তিকে সমৃদ্ধ করেছেন।
জিয়াউর রহমান উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি সামনে রেখেই বিএনপি গঠন করেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর অনেকেই মনে করেছিল, বিএনপি ধসে যাবে। কিন্তু ধসে যায়নি। তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া দায়িত্ব নিয়েছেন। আপসহীনভাবে স্বৈরাচার সরকারকে হটানোর জন্য দীর্ঘ ৯ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এ রকম নেত্রী বাংলাদেশে আর কেউ নেই।
জনগণ খালেদা জিয়াকে ভালোবাসে বলেই বর্তমান সরকার তাঁকে অন্যায়ভাবে কারাগারে আবদ্ধ করে রেখেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়ে দেশ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। কিন্তু এতেও কোনো লাভ হবে না। তিনি দূর থেকেই সঠিকভাবে বিএনপি পরিচালনা করছেন। আমরা তাঁর নেতৃত্বেই ঐক্যবদ্ধ আছি। গুম-খুন, হামলা-মামলা দিয়েও দলের মধ্যে কোনো বিভক্তি তৈরি করা যায়নি। এটা সম্ভবও না। জনগণের সমর্থন থাকলে কোনো দলকে বিলুপ্ত করা সম্ভব না। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি জনগণের সমর্থন নিয়েই টিকে থাকবে।
সূত্রঃ সমকাল
লেখক:
শামসুজ্জামান দুদু
ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি