চা বাগান সংলগ্ন বস্তি এলাকায় বসবাসকারী নারী শ্রমিকদের জীবন কাটছে বঞ্চনা আর বৈষম্যে। অর্থ সংকটে অনেকেই ঝুঁকছেন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এর মাঝে বাগানে কাজ পাচ্ছেন না এমন নারী শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি। এ অবস্থার উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও আটকে আছে খাতা কলমের বেড়াজালে এজন্য বাস্তবতার দেখা মিলেনি।
চা বাগান সংলগ্ন এলাকার বস্তিতে বসবাসকারী নারী শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি বিনোদন আর বিশ্রামের অধিকার থাকলেও মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের শ্রমিকরা সে অধিকারের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। শ্রমিকদের একাংশের দাবি, চা গাছ ছেঁটে যেমন নির্ধারিত মাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। চা শ্রমিকের জীবনটাও ছেঁটে দেওয়া চা গাছের মতোই লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের কুঁড়েঘরে বন্দি। প্রাচীন ভূমিদাসের মতোই চা বাগানের সঙ্গে বাঁধা তাদের নিয়তি।
ডব্লিউ জি নিউজের সর্বশেষ খবর পেতে https://worldglobal24.com/latest/ গুগল নিউজ অনুসরণ করুন
প্রায় ২০০ বছর ধরে কমলগঞ্জ উপজেলার ১৯টি চা বাগানে বংশোদ্ভূত পরম্পরায় কাজ করছেন চা শ্রমিকরা। তাদের শ্রমে এ শিল্পের উন্নয়ন হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। নারী শ্রমিকরা জানান, ঘুম থেকে উঠেই নাশতা সেরে কাজে বের হন আর বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যা নাগাদ। এরপর পরিবারের কাজে ব্যস্ত সময় কাটান। বাগানে যাদের কাজ নেই, তারা বিভিন্ন সাইটে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। কেউ কেউ আবার গাছ কাটাসহ অন্যের বাড়িতেও কাজ করেন। এভাবেই কাঁটে তাদের দিন। বস্তির অতিদরিদ্র্য ও চা শিল্পে শ্রমজীবীদের মধ্যে এক বিরাট অংশ রয়েছে বেকার। তাদের মধ্যে যুবতী ও মধ্যবয়সী নারীও রয়েছেন।
জীবিকার তাগিদে চা শিল্পের বাইরে কনস্ট্রাকশন, মাটি কাটা, মাথায় টুকরি নিয়ে ইট বহন, বালু ও পাথর বহন করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত অনেকেই। তবে কঠিন কাজে নিয়োজিত থাকলেও মজুরি বৈষম্যের কারণে তাদের অবস্থার উন্নতি নেই। তারা জানান, ঝড়ে ঘরের চালা উড়ে গেলে মালিকের অনুমতি ছাড়া মেরামত করা যায় না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ শ্রমিকরা অসহায়ত্ব আর উপোসে মৃত্যুর প্রহর গুনলেও নেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থা। প্রসূতি মায়েরা চিকিৎসার অভাবে, অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত অবস্থায় সন্তান জন্ম দেন। ওই কুঁড়েঘরটিই তাদের সন্তান প্রসবের স্থান। হাসপাতালের বেড তাদের জন্য সোনার হরিণ।
মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি তুলে আসছেন শ্রমিকরা। তবে সেগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন কাটাচ্ছেন। শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে চা বাগান আগলে রাখলেও তাদের আগলে রাখার মতো কেউ নেই। বস্তির শ্রমিক পারভীন বেগম ও শেফালি কর জানান, বাগানের হাসপাতালে ভালো চিকিৎসার অভাব। বাগানে যে কয়েকটি ছোট হাসপাতাল রয়েছে, তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঔষুধ এবং ডাক্তার না থাকায় সেবা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বাগানের কিছু ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। চা বাগানে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা বর্তমানে দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক বেকার নারী শ্রমিক বস্তি কিংবা শহরের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন, মাটি কাটা, নার্সারি, কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।
উপজেলার শমশেরনগর চা বাগানের মনি গোয়ালা, লছমী রাজভর, আলীনগর চা বাগানের রেবতী রিকিয়াশনসহ নারী শ্রমিকরা জানান, চা বাগানের নারীদের কাছ থেকে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়। বাগানে সারাদিন পরিশ্রম করে মজুরি ১৭০ টাকা, আর শহরে কাজ করলে সর্বোচ্চ ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দেওয়া হয়। অথচ পুরুষ শ্রমিকদের বেলায় এ মজুরি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়। মৌলভীবাজার চা শ্রমিক সংঘের নেতা হরি রিকিয়াশন ও কানিহাটি চা বাগানের শ্রমিক নেতা সীতারাম বীন জানান, চা বাগানের শ্রমিকরা কঠিন পরিশ্রম করলেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা রাম ভজন কৈরী জানান, চা শ্রমিকরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ দেশে বাস করছেন। অনেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, তবে চা শ্রমিকরা আজও পরাধীন, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। মজুরি বোর্ড চা বাগানের শ্রমিকদের প্রতি অবিচার করছে। নারী শ্রমিকরা কর্মস্থলে উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সম্ভব হয় না, এসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নারীরা।