পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ শান্তি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে

সরকার বান্দরবানের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। যার জন্য গঠিত শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে সংগঠনটির কয়েক দফায় ভার্চুয়াল মিটিং হয়। যে বৈঠকের সূত্র ধরে উভয় পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে দুই দফায় সরাসরি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই দুইটি বৈঠকে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে কেএনএফ ৬ টি দাবি উত্থাপন করে। যে ৬ দাবি নিয়ে আলোচনা শেষে গত ৫ মার্চ রুমা উপজেলার বেথেলপাড়ায় অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনায় উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে ছিল ৭ টি শর্ত।

যে ৭ শর্তের মধ্যে সরকার শান্তি প্রতিষ্ঠায় কুকি-চিন সম্প্রদায়ের জন্য দিয়েছিল ৫ টি প্রতিশ্রুতি। আর এই ৫ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কেএনএফ একটি মাত্র শর্ত প্রতিপালনের কথা ছিল। ওই শর্তটি প্রতিপালন হলে আগামি ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হত পরবর্তি সভা। কিন্তু সেই শর্তটিও মানল না কেএনএফ।

ফলে এ পরিস্থিতিতে কেএনএফ সঙ্গে শান্তি কমিটির আলোচনা সম্ভব না বলে বৃহস্পতিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছেন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সভা কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২৩ সালের ২৯ মে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে অরুণ সারকী টাউন হলে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৯ জুন স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে কয়েক দফা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের পর উভয় পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে সরাসরি সংলাপে বসার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর এবং পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ মার্চ দুই দফা সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সংলাপে কেএনএফের সকল প্রকার সশস্ত্র কার্যক্রম হতে বিরত থাকা ও অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত দুটি সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়। কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে চুক্তি ভঙ্গ করে বিভিন্ন সময়ে সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। ফলে এ আলোচনা সম্ভব হচ্ছে না।

বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা এর এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে উভয় পক্ষের সমঝোতার প্রেক্ষিতে আগামি ২২ এপ্রিল পুনরায় যে বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল তা আর হচ্ছে না।
শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির কয়েকজন সদস্য জানান, আলোচনায় কেএনএফ এর পক্ষে ৬ টি দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। এ ৬ দাবি নিয়ে আলোচনার জন্য তাদের শর্ত দেয়া হয়েছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার আলোচনা কার্যক্রম চলাকালে কেএনএফ কোনো ধরনের সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হবে না। কিন্তু গত মঙ্গলবার রাত ও বুধবার দিনে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা রুমা ও থানচি এলাকার সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি করে। এই সময় সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখার ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এটাতে শান্তি প্রতিষ্ঠার আলোচনায় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়।যদি পরবর্তীতে ১৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণে মুক্তি পায় সেই ব্যাংক কর্মকর্তা।

সমঝোতা স্মারকে কি আছে

গত ৫ মার্চ বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার বেথেল পাড়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফ এর মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপে উভয় পক্ষের মধ্যে ৭ টি শর্ত নিয়ে এক সমঝোতা স্মারক হয়। এতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষে আহ্বায়ক বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা এবং কেএসএফ এর পক্ষে সাধারণ সম্পাদক লালজংময়।

এতে থাকা ৭ শর্ত সমুহ হল : 

১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট কেএনএফ কর্তৃক দাখিলকৃত ৬ দফা দাবি এবং প্রণীত খসড়া চুক্তি পরবর্তী সংলাপে আলোচনা স্বাপেক্ষে বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
২. কারাগারে বন্দি কেএনএফ/কেএনএ সদস্যদের জামিনে মুক্তির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যথাশীঘ্রই সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং সেনা জোনে বন্দি সদস্যদের (যদি থাকে) মুক্তির ব্যাপারে সেনা রিজিয়নকে অবগত করা হবে।
৩. কেএনএফ কর্তৃক উত্থাপিত পয়েন্টে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পোর্টার নিযুক্তির অভিযোগের বিষয়টি (বিশেষকরে রেমাক্রী প্রাংসা এলাকায়) যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হবে এবং সেনা রিজিয়নকে সুষ্ঠ পারিশ্রমিক প্রদানের বিষয়ে অবগত করা হবে। যদি পোর্টার নিয়োগ করা হয় তবে সকল সম্প্রদায়কে সমন্বিতভাবে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
৪. সরকারের পক্ষ থেকে কুকি-চিন সম্প্রদায়ের ভাগ্যোন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং খাদ্য সহায়তার কার্যক্রম পূর্বের ন্যায় অব্যাহত থাকবে। এবিষয়ে আরো তরান্বিত করতে হবে।

৫. সকল কুকি-চিন সম্প্রদায়ভূক্তদের নিজ আবাসস্থলে ফেরত আসার ব্যাপারে অনুকূল পরিবেশ তৈরীর জন্য
সরকার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৬. উদ্ভূত যে কোন সমস্যা সংলাপের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে উভয় পক্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শান্তি প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম চলমানকালীন সময়ে কেএনএফ কোন প্রকার সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হবে না এবং আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এতদ উদ্দেশ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় কেএনএফ কর্তৃক নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখা হবে।
৭. শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরবর্তী সংলাপ সম্ভাব্য আগামী ২২ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে (আলোচনা স্বাপেক্ষে) অনুষ্ঠিত হবে।

আর সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরের পর এক মাস না যেতেই কেন কেএনএফ সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কেএনএফ চেয়ারম্যান নাথান বমের উপদেষ্টা লাল এংলিয়ান বম জানিয়েছেন, রুমা এবং থানচিতে যে ঘটনা ঘটেছে তা কারা ঘটিয়েছে আমি এখনও জানি না। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপের পর প্রকৃত তথ্য জানতে পারব। এখন সরকারি বাহিনী কেএনএফকে দায়ী করছে। আমি বলব, বান্দরবানে কি সংগঠন হিসেবে শুধু কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট আছে। আরও সশস্ত্র সংগঠন কি নেই? ওসব সংগঠনের সদস্যরা যে এমন কান্ড ঘটায়নি সেটা কীভাবে নিশ্চিতভাবে বলবেন। হয়তো দেখা যাবে অন্য সংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এই ঘটনা ঘটিয়ে কে কেএনএফকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।

ডব্লিউ জি / এলএমএইচ

শেয়ার করুন:

Recommended For You